Hot

ডুবে যাবে ঢাকা

ভরাট হচ্ছে আড়িয়াল বিলসহ ঢাকার আশপাশের নদী-নালা-বিল নদী ও বিল রক্ষায় হাইকোর্টের নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে ঢাকা : ড. আইনুন নিশাত :: প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো ভরাট করায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নামছে, বাড়ছে সুপেয় পানির সঙ্কট : প্রফেসর চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল

সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে ঢাকা। রাজধানীর আশপাশের নদী-নালা-বিলসহ যত বড় বড় প্রাকৃতিক পানির উৎস ছিল তা ভরাট ও অবৈধ দখল হচ্ছে। সেসব স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এর ফলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জায়গা একেবারেই কমে গেছে। আর তাতে সামন্য বৃষ্টি হলেই রাজধানী ঢাকা পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। আর ঢাকার এই পানিতে তলিয়ে যাওয়াটা অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকার আশপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার দুই পাড় ইতোমধ্যে অনেক অবৈধ দখল হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ না থাকায় ময়লা-অবর্জনায় এসব নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন হাউজিংয়ের নামে ভূমিদস্যুরা ঢাকার চারপাশের বড় বড় বিল ডোবা ভরাট করছে। আশুলিয়া থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জ হয়ে মাওয়া পর্যন্ত প্রাকৃতিক পানির যেসব উৎস ছিল তা ভরাট হয়ে গেছে। এদিকে কুড়িল থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ পর্যন্ত যেসব ছোট বড় বিল ছিল তাও ভরাট হয়ে বিভিন্ন হাউজিংয়ের সাইনবোর্ড ঝুলছে। সর্বশেষ ভূমি দস্যুদের নজর পড়েছে মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলের ওপর। এটি ভরাট হলে ঢাকার পানিবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেবে। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি কোমর পানিতে তলিয়ে যাবে। পানি যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকবে না। এতে ঢাকা দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবে থাকতে পারে এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রখ্যাত পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার ৪টি নদী ও ৪৭টি খাল এ মহানগরীর পানি নিষ্কাশনে বিশেষ ভূমিকা রাখত। কিন্তু এসব নদী খাল ভারাট করে অবৈধ দখল হচ্ছে। রাজধানীর অনেক খাল এখন অস্তিত্বহীন। এছাড়া প্রাকৃতিক পানির যেসব উৎস ছিল তুরাগের পাড়ে, যেমন আশুলিয়ায় ছোট বড় বিল, ভরাট করে হাউজিং কম্পানিগুলো বিল্ডিং করছে। এদিকে বালু নদীর আশপাশে রামপুরার পূর্ব থেকে সেই রূপগঞ্জ পর্যন্ত সব ডোবা বিল ভরাট হয়ে গেছে। এর ফলে বৃষ্টি হলে ঢাকার পানি সহজে নামতে পারছে না। কোথায় যাবে পানি, যাওয়ার তো জায়গা নেই। বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষ্যাও মৃতপ্রায়। তারপরও এসব নদী হয়ে কিছু পানি আড়িয়াল বিলে গিলে জায়গা নিত। এখন যদি সেই আড়িয়াল বিলও ভরাট হয়ে যায় তাহলে একটু বৃষ্টিতেই ঢাকা ডুবে যাবে। আড়িয়াল বিল ভরাট ও দখল বন্ধের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট। এ নির্দেশনা যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়। তা না হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।

সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। পানিবদ্ধতায় নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অথচ প্রতি বছরই পানিবদ্ধতা নিরসনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। বছর বছর অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে ভোগান্তির পরিমাণ আরো বাড়ে। সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা গত ১২ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও এ টাকা পানিতেই গেছে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

ঢাকার আশপাশের বিল ও প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো ভরাট করায় ঢাকা ডুবে যাওয়ার শঙ্কা যেমন বাড়ছে পাশাপাশি এর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নামছে। আর তাতে বাড়ছে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা এবং সুপেয় পানির সঙ্কট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি ভূত্তত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট পানি গবেষক জাতীয় পানিনীতি কমিটির সদস্য প্রফেসর চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে হারে খাল-বিল-ডোবা ভরাট করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠছে তাতে চারিদিক শুধু কংক্রিটে ভরে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টির পানি নিচে নামতে পারছে না। মানুষের নিত্য দিনের প্রয়োজন মেটাতে, শিল্প কারখানার চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পানি নিচ থেকে তোলা হচ্ছে। কিন্তু রিচার্জ হচ্ছে না। কারণ সর্বত্র কংক্রিট ঢেকে গেছে। বৃষ্টির পানি নিচে নামতে পারছে না। পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ভরাট করে বৈধ-অবৈধভাবে ভবন হচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে ঢাকা পানির মহাসংকটে পড়তে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির সঙ্কট যেমন বাড়ছে তেমনি ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়ছে। তিনি বলেন, অবৈধ খাল বিল দখল বন্ধ করে ঢাকার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ জাতীয় পরিকল্পনা (ন্যাশনাল স্ট্যাডিজ) থাকলেও তা শুধু কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। আইন আছে বাস্তবায়ন নাই। আইন আর পরিকল্পনা থাকলে চলবে না তা বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু কথা না বলে মাঠে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে ঢাকা আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

দখলে দূষণে রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো মৃতপ্রায়। শুকনো মৌসুমে বালু নদী যেন এক ধূ ধূ বালুচর। গত ১৪/১৫ বছরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা এ চার নদী পাড়ের অন্তত ৪৪ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার এলাকার জমি দখল হয়েছে। কোথাও বালু ফেলে ভরাট করেছে প্রভাবশালী দখলদার ও ভূমিদস্যুরা, আবার কোথাও বা কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে নষ্ট করছে নদীর পানিসহ আশেপাশের পরিবেশ। নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা আখ্যায়িত করে সর্বোচ্চ আদালত তা রক্ষার নির্দেশ দিলেও তা আজও কার্যকর হচ্ছে না। ভূমিদস্যুরা বেপরোয়াভাবে গিলে খালে নদী-বিল সব। সর্বশেষ গত ১৬ আগস্ট মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিল ভরাট ও দখল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

নদী-বিল বা প্রকৃতিক পানির উৎস ভরাট করার পাশাপাশি ঢাকার পানিবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়নও দায়ী। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসেই ঢাকার বাসিন্দারা মারাত্মকভাবে পানিবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে রাজধানীর বিভিন্ন অংশ ও প্রধান সড়কগুলো ডুবে যায়। মূলত রাজধানীর বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার খাল এবং নর্দমার লাইনের মাধ্যমে নদীতে পৌঁছানোর কথা থাকলেও একদিকে নর্দমার পানি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং অন্যদিকে খালগুলো অবৈধভাবে দখলের কবলে চলে গেছে। ফলে একটু ভারি বৃষ্টিতেই পানিবদ্ধতা ঢাকাবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারসের (বিআইপি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ৯ বছরে ঢাকা মহানগর এবং এর আশেপাশে কমপক্ষে তিন হাজার ৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ভরাট হয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকার ৩৬ শতাংশ জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। তারা আরো বলছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন নগরীর বিভিন্ন অংশে ৯ বছর আগে ১ লাখ ৯৩৭ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ছিল, কিন্তু এরই মধ্যে ২২ শতাংশ অর্থাৎ ২২ হাজার ১৫৬ একর ভরাট করা হয়েছে, যা প্রতিবছর জলাবদ্ধতা ইস্যুতে ব্যাপক অবদান রাখছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, নগরীতে যতগুলো প্রাকৃতিক খাল তার অনেকাংশ দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারছে না। বিল ও ডোবা বৃষ্টির পানির আধার হিসেবে কাজ করে থাকে। অবৈধভাবে অনেক বিল ভরে সেখানে ঘরবাড়ি, আবাসন প্রকল্প, অফিস ভবন অথবা শপিংমল করা হয়েছে। এভাবে অতি দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে অল্প বৃষ্টিতেই পানিবদ্ধতা ও নগর বন্যা দেখা দিচ্ছে। নগরীর পানিবদ্ধতা ও নগর বন্যা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বিপর্যয় আরো বাড়বে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button