ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে কাঁদলেন বাইডেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে শিকাগোয় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলন। সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া সম্মেলন চলবে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। এতে দলটির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি কয়েক হাজার আমন্ত্রিত অতিথি অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনের প্রথমদিন শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সপরিবারে যোগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় দলের জাতীয় এই সম্মেলনে শেষবারের মতো ভাষণ দেন তিনি। বাইডেন যখন মঞ্চে উঠছিলেন, তখন দর্শক সারির সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান দেখান।
একইসঙ্গে, উপস্থিত নেতাকর্মীরা সমস্বরে বলে ওঠেন ‘ধন্যবাদ জো’। এ ঘটনার পর বাইডেন বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে আবেগে কেঁদেও ফেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, কঠিন সময় শেষ, এখন ভালো সময়। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে দেশের জন্য কাজ করেছেন বলেও জানান তিনি। মঞ্চে মেয়ে অ্যাশলি বাইডেনকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকেন বাইডেন। এর পর চোখের পানি মুছতে দেখা যায় তাকে।
আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাইডেনকে চাপ দিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বহু নেতা। তিনি তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয় বলে উল্লেখ করেন বাইডেন। নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে জয়ী করতে মার্কিন ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান বাইডেন।
সম্মেলনে সমবেত জনতার উদ্দেশে অ্যাশলি বাইডেন বলেন, তার বাবা জো বাইডেন সত্যিকার অর্থে একজন কন্যাসন্তানের বাবা। তিনি নারীদের সব সময় মূল্যায়ন করেন। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন। সম্মেলনে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বিভিন্ন কাজের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আরও উন্নত একটি যুক্তরাষ্ট্র তৈরিতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। সম্মেলনের শেষদিন বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন গ্রহণ করবেন।
শেষ ভাষণে ‘আমেরিকা, আমি আমার সর্বোচ্চটা তোমাকে দিয়েছি উল্লেখ করে বাইডেন বলেন, গণতন্ত্রকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। আমরা আমেরিকার আত্মাকে রক্ষার জন্য লড়ছি। এ সময় কমলা হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে আপনারা কমলা হ্যারিসকে বিজয়ী করুন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে দলের জাতীয় সম্মেলনে এটাই ছিল তার শেষ ভাষণ। ফলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড় থেকে হঠাৎ সরে যাওয়া বাইডেন ভাষণে কী বলেন, সেদিকেই নজর ছিল সবার।
বাইডেন মঞ্চে ওঠার আগে আকস্মিকভাবে সেখানে হাজির হয়ে নজর কাড়েন কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ দিতেই হঠাৎ এই আগমন বলে জানান তিনি। কমলা বলেন, জো, আপনার ঐতিহাসিক নেতৃত্বের জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল জো বাইডেনের। কিন্তু গত জুনের শেষের দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক টেলিভিশন বিতর্কে কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
এর পর ভোটার জরিপে বাইডেনকে বেশ পিছিয়ে পড়তে দেখা যায়। ফলে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী না হওয়ার জন্য নিজ দলের ভেতরেই চাপে পড়েন তিনি এবং একপর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে আসেন। এমন পরিস্থিতিতে এক মাসেরও কম সময় আগে নির্বাচনী দৌড়ে যোগ দেন কমলা। এবারের সম্মেলনে তার পক্ষেই ভোট চাচ্ছেন দলটির নেতারা। বৃহস্পতিবার সম্মেলনের শেষদিনে তিনি ফের মঞ্চে উঠবেন। কিন্তু প্রথমদিনেই হুট করে হাজির হওয়ায় উপস্থিত নেতাকর্মীরা বেশ অবাক হন।
হাজার হাজার নেতাকর্মী উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে কমলা হ্যারিসকে সম্মেলনে স্বাগত জানান। সেই সঙ্গে স্লোগান চলতে থাকে: যখন আমরা লড়াই করি, আমরা জিতে যাই। অল্প সময় মঞ্চে অবস্থানকালে তিনি বাইডেনকে ধন্যবাদ দেওয়ার বাইরে তেমন কিছু বলেননি। রীতি অনুযায়ী, সম্মেলনের শেষদিনে তিনি আবারও মঞ্চে উঠবেন। সেদিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষণ দেবেন।
কমলা হ্যারিস চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে মঞ্চে আসেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আরেক প্রভাবশালী নেতা হিলারি ক্লিনটন। তিনি যখন মঞ্চে উঠছিলেন, তখন দর্শক সারি থেকে হিলারি, হিলারি আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কমলা হ্যারিসের মতো তিনিও ভাষণ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বাইডেন হোয়াইট হাউসের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন বলেও মন্তব্য হিলারির।
সাবেক এই ফাস্ট লেডি বলেন, আজীবন আপনি যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মানুষের পাশে থেকেছেন, সেটার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জো বাইডেন। একই সঙ্গে, কমলা হ্যারিসকে বিজয়ী করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। খবর আলজাজিরা, এএফপি ও বিবিসি অনলাইনের।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন হিলারি। কিন্তু সেবার তিনি ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন। কাজেই এবারের নির্বাচনে জিতলে কমলা হ্যারিস প্রথম মার্কিন নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার রেকর্ড গড়বেন।
এদিকে সোমবারের সম্মেলন চলাকালে আশপাশের এলাকায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ করেন। সম্মেলন শুরুর আগ থেকেই তারা বিভিন্ন স্থানে সমবেত হতে থাকেন। গাজাযুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভ শেষে পদযাত্রাও করেন তারা। ইসরাইলকে সাহায্য করা বন্ধের পাশাপাশি গাজায় দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে, ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় সম্মেলন বন্ধ করার দাবিও জানান তারা। বৃহস্পতিবার সম্মেলনের শেষদিনেও বড় বিক্ষোভ করার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
উল্লেখ্য, গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েকমাস ধরেই বিক্ষোভ হতে দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া ওই বিক্ষোভ সামাল দিতে গিয়ে কিছু কিছু স্থানে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে পুলিশকে। কয়েক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে তাদের। এতে উভয়পক্ষের অনেকে আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে সাম্প্রতিক সাইবার হামলার পেছনে ইরান জড়িত ছিল বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সোমবার এফবিআই ও অপর কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো যৌথ এক বিবৃতিতে এই তথ্য নিশ্চিত করে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে ইরান। এর লক্ষ্য ছিল বিভাজন উসকে দেওয়া এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা দুর্বল করা।
ট্রাম্পের প্রচার শিবির ১০ আগস্ট ইরানের দিকে আঙুল তোলে এবং দাবি করে যে তাদের অভ্যন্তরীণ বার্তাগুলো হ্যাক করা হয়েছে। তবে, ইরানি কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ইরানি হ্যাকাররা কমলা হ্যারিসের প্রচার শিবিরকেও টার্গেট করেছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, গোয়েন্দা সম্প্রদায় আত্মবিশ্বাসী যে ইরানিরা সামাজিক কৌশল এবং অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে উভয় রাজনৈতিক দলের প্রচার শিবিরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। তারা আরও জানায়, এ ধরনের কার্যকলাপ, যার মধ্যে তথ্য চুরি এবং প্রকাশ রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার উদ্দেশে পরিচালিত। ট্রাম্পের প্রচারে একটি স্পিয়ার-ফিশিং ইমেইল পাঠানো হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, টার্গেটকে ক্ষতিকর লিংকে ক্লিক করানোর উদ্দেশে এমনটি করা হয়েছিল।
কমলা হ্যারিসের প্রচার দলও একই ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছে, তবে তা ব্যর্থ হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে। সোমবারের বিবৃতিতে এফবিআই, ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অফিস এবং সাইবার সিকিউরিটি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সির মতো সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছে, এই কৌশলগুলো নতুন নয়। এর আগে রাশিয়া ও ইরান পূর্বের মার্কিন নির্বাচনে এই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এর আগে কমলা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কাপুরুষ আখ্যা দেন। রবিবার কমলা বলেন, ট্রাম্প বরাবরই তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছোট করতে চান। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন কাপুরুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে কমলা এ মন্তব্য করেন। এই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এই ধরনের বিকৃত ঘটনা ঘটেছে। একজন নেতার শক্তির পরিমাপ হচ্ছে, আপনি কাকে পরাজিত করেছেন তার ওপর ভিত্তি করে। তবে আমরা জানি যে একজন নেতার শক্তির আসল পরিমাপ হলো, আপনি কাকে উপরে তুলেছেন তার ওপর ভিত্তি করে। যারা কোনো মানুষকে ছোট করতে চায় তারা ¯্রফে কাপুরুষ। এর আগে, এই পেনসিলভানিয়াতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প বলেন, আমার চেহারা কমলার চেয়েও সুন্দর।
তবে তিন সপ্তাহ ধরে কমলাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এরইমধ্যে তিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টকে পাগল বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ট্রাম্প কমলার জাতিসত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এর আগেও কমলার সমালোচনায় মুখর হন ট্রাম্প। এই নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দ্রুত গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি জানালে ট্রাম্প এর কঠোর সমালোচনা করেন।