তথ্যপ্রযুক্তির বৈশ্বিক সব সূচকেই পিছিয়ে দেশ
বিপুল বিনিয়োগের পরও তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। ইন্টানেটের গতি ও ব্যবহার, ডিজিটাল জীবনমান, প্রযুক্তির ব্যবহার, ই-গভর্নমেন্ট, সাইবার নিরাপত্তা, ফ্রিল্যান্সিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রায় সব বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার তলানিতে। অনেক সূচকে পাশের দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান থেকেও পিছিয়ে। ফলে ঘোষণা দিয়ে দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হলেও জীবনমান সেভাবে ডিজিটাল হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলেও তা খরচ হয়েছে অপরিকল্পিত। দেশজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে শুধু ডিজিটাল অবকাঠামো। টেকসই নীতিমালার আলোকে পরিকল্পিত ডিজিটালাইজেশন হয়নি। ফলে ইউনিয়ন পর্যন্ত ইন্টারনেট কেবল পৌঁছেছে ঠিকই, ডিজিটাল সেবার দরজা প্রশস্ত হয়নি।
জানা গেছে, দেশের ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে এবং এ বিষয়ে দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে ২০১০ সাল থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রকল্প শেষ হয়েছে, কিছু চলমান। অবকাঠামো খাতে ১৯ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। সাইবার নিরাপত্তা পরিকাঠামো গড়ে তুলতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ১২১৩ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বিপুল বিনিয়োগের পরও অপরিকল্পিত উদ্যোগ ও অব্যবস্থাপনায় নাগরিক জীবনে ডিজিটাল বিপ্লব সেভাবে ঘটেনি। ডিজিটাল খাতে সরকারের অন্যতম সাফল্য তথ্য বাতায়নের আওতায় প্রায় ৫০ হাজার ওয়েবসাইট তৈরি। যদিও এসব ওয়েবসাইটে ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। প্রায় নিয়মতি সাইবার হামলা হচ্ছে সাইটগুলোতে। এতে বেহাত হচ্ছে ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, দেশে ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে উঠলেও প্রযুক্তি খাতের সঠিক বিকাশ হয়নি। দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলা যায়নি। ফলে এ খাতে টেকসই উন্নয়ন ঘটেনি। তাই সূচকগুলোতে সব সময় বাংলাদেশ পেছনের দিকে থাকছে।
ডিজিটাল সূচকে ভুটানের পর বাংলাদেশ
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) গত জুনে আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (আইডিআই) ২০২৪ প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশ ১০০-এর
মধ্যে ৬২ স্কোর করেছে, যার বৈশ্বিক গড় স্কোর ৭৪ দশমিক ৮ এমনকি নিম্ন-মধ্যম
আয়ের দেশগুলোর গড় স্কোর ৬৪ দশমিক ৮ থেকেও কম। তালিকায় মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম ও ভুটানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
আইডিআই সূচকে ১০ নির্দেশকের মধ্যে ৭টিতেই বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের গড় স্কোরের চেয়ে পিছিয়ে। ব্যক্তি ও পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহার, মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ডেটা, ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাংলাদেশের স্কোর ৪০-এর ঘরই পেরোয়নি।
ইন্টারনেট গতির তালিকায় নিচে
ওকলা স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স মে মাসের ফল অনুসারে মোবাইল ইন্টারনেট সূচকে ১৪৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। যেখানে প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১৬তম। তালিকায় কেনিয়াও বাংলাদেশের আগে রয়েছে, অবস্থান ৯৪তম। পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সূচকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। তালিকায় ১৪৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৮তম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়ও পেছনে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রস্তুতি সূচকে (এআইপিআই) বিশ্বের ১৭৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম। তালিকায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, রুয়ান্ডা, ঘানাও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। জুনে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে শূন্য দশমিক ৮০ মান নিয়ে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর। যেখানে বাংলাদেশের এআই প্রস্তুতির মান শূন্য দশমিক ৩৮। এর মধ্যে ডিজিটাল অবকাঠামোয় বাংলাদেশের মান শূন্য দশমিক শূন্য ৯।
নিচের দিকে ডিজিটাল জীবনমান
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, দেশ ডিজিটাল যুগ পেরিয়ে স্মার্ট যুগে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ডিজিটাল জীবনমান সূচকে বিশ্বের ১২১
দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৮২তম অবস্থানে। এশিয়ার ৩২ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৫। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক ডিজিটাল কোয়ালিটি
অব লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ প্রতিবেদনে
এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশ পাঁচ ধাপ পিছিয়েছে। তালিকায় ভারত ৫২তম অবস্থানে এবং পাকিস্তান ৯৩তম। ইন্টারনেট সামর্থ্য, ইন্টারনেটের মান, ই-অবকাঠামো, ই-নিরাপত্তা, ই-সরকার; পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি করা হয়।
প্রতিবেদন বলছে, সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। বৈশ্বিক গড় ৫৩ এমবিপিএস হলেও বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট
গড় গতি ২০ এমবিপিএস। ই-গভর্নমেন্ট সূচকে বাংলাদেশ তালিকার ৭৩ এ, যা বৈশ্বিক গড়মানের নিচে। ইন্টারনেট ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৭তম; ই-সিকিউরিটি র্যাঙ্কিংয়ে ৮৫তম।
ফ্রিল্যান্সিংয়েও পিছিয়ে
মার্কিন সাময়িকী সিইওওয়ার্ল্ড এপ্রিলে ফ্রিল্যান্স কাজের জন্য সেরা গন্তব্যের ৩০
দেশের তালিকা প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশ রয়েছে ২৯তম স্থানে। তালিকায় ভারত
রয়েছে দ্বিতীয়, পাকিস্তান ২৮তম স্থানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা কম থাকায় ভালো কাজ দেশে আসে কম। যদিও ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকেই।