তফসিল ঘিরে উত্তাপ
একতরফা তফসিল প্রত্যাখ্যান করবে বিএনপিসহ বিরোধীরা
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘিরে রাজনীতিতে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপিসহ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা সরকারবিরোধী দলগুলো ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ ছাড়া তফসিল ঘোষণার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকেও দলগুলো ইতোমধ্যে তাদের এই বার্তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। বিএনপি ‘শর্তহীন সংলাপের পরিবেশ’ তৈরির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তফসিল কমপক্ষে দুই সপ্তাহ পেছানো এবং নেতাদের মুক্তি দেয়ার বিষয়টি কূটনৈতিক চ্যানেলে উত্থাপন করেছে বলে জানা গেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে আজ বুধবার সন্ধ্যায়। রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ‘একতরফা’ উল্লেখ করে এ তফসিল প্রত্যাখ্যান করবে বিরোধী দলগুলো। একই সাথে কর্মসূচি জোরালো করে এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে তারা।
বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে শর্তহীন সংলাপে বসতে গত সোমবার বড় তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এই চিঠির বিষয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে স্পষ্ট কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। জাতীয় পার্টি সংলাপের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছে। বিএনপিও এই চিঠিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
ডোনাল্ড লুর এই চিঠির পর রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় উঠে আসে এ সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা না-ও হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়েছে, আজ বুধবার তফসিল ঘোষণা হতে পারে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণা করতে ব্যতিব্যস্ত হলেও বিএনপিসহ এক দফার আন্দোলনে থাকা দলগুলো মনে করছে, দেশে এই মুহূর্তে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং তফসিলের কোনো পরিবেশ নেই। বিএনপি কমপক্ষে দুই সপ্তাহ তফসিল পেছানো এবং শীর্ষ নেতাদের জামিনে মুক্তি দিয়ে শর্তহীন সংলাপের পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়েছে। গত তিন দিন আগে দলটির পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের মাধ্যমে সরকারকে এমন বার্তা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির দাবি, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই দু’টি বিষয় মানা হলে সংলাপের পরিবেশ তৈরি হবে। তখন সেই সংলাপে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া, কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে- আলোচনার মাধ্যমে তা নির্ধারিত হতে পারে। যদিও সংলাপ নিয়ে বিএনপির অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়, একই সাথে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে দলটি অনড় রয়েছে।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, রাজপথে সঙ্ঘাত-সহিংসতা এড়িয়ে সংলাপের মাধ্যমে যদি নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা করা যায়, সেটি দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক। দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সেই অপশনটি ব্যবহার করতে চায়। তবে অতীতের মতো সংলাপ ফলপ্রসূ না হলে সে ক্ষেত্রে রাজপথে সমাধানের ব্যাপারেও নেতাকর্মীদের অবস্থান থাকবে।
বিএনপি এখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে রয়েছে। গত দুই সপ্তাহে চার দফায় দেশব্যাপী ৯ দিনের অবরোধ এবং এক দিনের হরতালের কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এমন পরিস্থিতিতে একতরফাভাবে তফসিল ঘোষণা করা হলে রাজপথ আরো উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, যদি সবকিছু উপেক্ষা করে একতরফাভাবে তফসিল দেয়া হয়, তাহলে বিএনপি ও শরিকরা কঠোর আন্দোলনের পথে যাবে। তফসিল প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের এবং সে কর্মসূচি খুব শক্তভাবে পালন করা হবে। নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ঘেরাও কর্মসূচিও দেয়া হতে পারে।
একতরফা তফসিল ঘোষণার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার জনগণের দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন করার জন্য উন্মাদ, উান্ত হয়ে গেছে। সরকার তার আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে অবৈধভাবে তফসিল দেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে। আমরা কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, এই তফসিল নাটক বন্ধ করুন। আগে পদত্যাগ করুন, কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা দিন, এই দলদাস নির্বাচন কমিশন বাতিল করুন।
সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে বলে মনে করে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংলাপে যাওয়ার কোনো পরিবেশ নেই। সারা দেশ এখন অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহতভাবে চলছে। বিশেষ করে বিএনপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গ্রেফতার-আটক চলছে। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির মহাসচিব, সিনিয়র নেতারাসহ অন্তত ১৪ হাজার বন্দী রয়েছে কারাগারে। ফলে সংলাপের আগে অফিস অবমুক্ত করা, নেতাকর্মীদের মুক্তি এসব প্রণিধানযোগ্য। এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকেই।
নির্বাচন কমিশনকে একতরফা তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, নির্বাচনের পূর্বে প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগে বিরোধী দলকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বিতাড়িত করা, বেশুমার আটক-গ্রেফতার ও নিপীড়ন করে নীলনকশার অংশ হিসেবে একতরফা তফসিল ও নির্বাচনের ঘোষণা হবে সঙ্ঘাত এবং রক্তপাতকে উসকানি দেয়া। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তফসিল তফসিল নাটক করলে পরিস্থিতি ভালো হবে না। ইসি তফসিল ঘোষণা করে বাসায় ফিরতে পারবেন না, আমরা জনগণকে নিয়ে রাজপথে প্রতিহত করব। নির্বাচন কমিশন যে দিনই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে সে দিনই নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল করার ঘোষণা আগেই দিয়েছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন। এই দলটির নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই কর্মসূচি ঘোষণার আগে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।
নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা না করে তড়িঘড়ি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে আরো ছয়টি ইসলামী দল। গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সমমনা ইসলামী দলগুলোর নেতারা এ দাবি জানিয়ে বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তড়িঘড়ি তফসিল ঘোষণা হবে জাতির সাথে তামাশার শামিল। এ তামাশা বন্ধ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
এক দফা দাবিতে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ ডাকে বিএনপি। কিন্তু ওই মহাসমাবেশকে ঘিরে পুলিশের সাথে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এর পর থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। এ ছাড়া দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে বাকি নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার পাশাপাশি কূটনৈতিক অঙ্গনে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বিএনপি।