Hot

তরল স্বর্ণের বিশ্বজয়, রপ্তানি দ্বিগুণ

সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে এগোচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান। কিশোরগঞ্জের ভৈরব, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল ঘুরে পাদুকা, আগর ও মণিপুরি তাঁতশিল্প নিয়ে সমকালের স্টাফ রিপোর্টার জসিম উদ্দিন বাদল তৈরি করেছেন তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। প্রথম পর্বে আজ থাকছে বাংলাদেশের ‘তরল স্বর্ণ’খ্যাত আগর-আতরের অগ্রযাত্রা, সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত।

বেশির ভাগ বাড়ির উঠান, ঘরের বারান্দা ও এর আশপাশজুড়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। দা, কুড়াল আর ছোট্ট বাটালির খটখট শব্দে যেন মুখরিত পুরো বাড়ি। উঠানের এক পাশে কেউ ফালি ফালি করে আগর গাছ কাটছেন। আরেক পাশে কেউ ফালি করা গাছ থেকে বের করছেন লোহার তারকাঁটা বা পেরেক। ঘরের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে বসে নারীরা ব্যস্ত রয়েছেন ফালি কেটে ছোট ছোট টুকরো করার কাজে।

এরপর টুকরোগুলো থেকে কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে মূল্যবান রপ্তানিপণ্য আগর ও আতর। কর্মময় এ দৃশ্যটি মৌলভীবাজারের বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নের বক্স বাড়ির। শুধু এই বাড়ি নয়, সম্প্রতি সরেজমিনে ওই ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, কর্মব্যস্ততার এমন চিত্র রয়েছে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে।

স্থানীয়রা জানান, এভাবে আগর গাছ থেকে আগর ও আতর সংগ্রহ করে তা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে; যা তরল সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। গত অর্থবছরে আগর-আতর রপ্তানি করে দেশের আয় হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ; যারা যুগযুগ ধরে এ শিল্পের ওপর ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। আগর মূলত একটি গাছের নাম। এর আভিধানিক অর্থ উৎকৃষ্ট বা সুগন্ধবিশিষ্ট কাঠ।

মৌলভীবাজার সদর থেকে ৬০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন। সম্প্রতি সরেজমিনে সুজানগরের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, আঁকাবাঁকা গ্রামীণ কাঁচা-পাকা রাস্তার দু’পাশে সারি সারি আগর গাছ। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে বনে-বাগানে কিংবা সমতল ভূমি প্রায় সর্বত্রই উৎপাদন হচ্ছে আগর গাছ। বেশির ভাগ বাড়িতে গড়ে উঠেছে আগর-আতর উৎপাদনের কারখানা। গ্রামের পথ ধরে হাঁটলেই নাকে আসবে আতরের সুঘ্রাণ।

স্থানীয়রা জানান, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলাকে আগর-আতরের আঁতুড়ঘর বলা হয়। জেলার বড়লেখা, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ীসহ বিভিন্ন উপজেলায় আগর চাষ হচ্ছে। ২০১৫ সালে আগরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার পর বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ বাড়ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আগর-আতরকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলে এর কদর আরও বেড়েছে।

আগর-আতরের খনি সুজানগর
সবচেয়ে বেশি আগর-আতর উৎপাদন হয় সুজানগর ইউনিয়নে। এ এলাকায় আগর চাষের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পূর্ব দিকে পাহাড়, পশ্চিম দিকে হাওর তারই মাঝখানে সুজানগর। এ ইউনিয়নের সালদিঘা, রফিনগর, হাসিমপুর, চিন্তাপুর, বড়থলসহ আশপাশের গ্রামে বেশি আগরের চাষ হয়। সম্প্রতি কলাজুরার হাতলিয়া গ্রামে বিভিন্ন নার্সারিতে দেখা মিলছে হাজার হাজার আগরচারার। পানি জমে না এমন উঁচু জায়গায় করতে হয় নার্সারি। গাছটি লম্বায় হয় প্রায় ১৫ থেকে ৪০ মিটার। বেড় বা ব্যাস হয় শূন্য দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার। ছোট শাখা-প্রশাখাযুক্ত সোজা লম্বা গাছটি দেখতে এবং আকার আকৃতিতে শাল বা গজারি গাছের মতো। পাতা দেখতে লিচু পাতার মতো।

আগর থেকে যেভাবে আতর হয়
গাছ থেকে আগর-আতর পেতে অপেক্ষা করতে হয় যুগের পর যুগ। চারা লাগানোর পাঁচ-ছয় বছর পর পুরো গাছে সারিবদ্ধভাবে এক-দেড় ইঞ্চি পরপর পেরেক মারা হয়। গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেরেক মারার স্থানে কিছুটা ক্ষত সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে এক ধরনের রস বের হতে থাকে, যা পেরেকের চারপাশে জমে কালো হয়ে যায়।

এভাবে ১০ থেকে ১৫ বছর রাখার পর গাছ কাটা হয়। তারপর ছোট ছোট ফালি করে কাটার পর পেরেক খোলা হয়। ওই ফালিকে ছোট ছোট টুকরো করা হয়; যেগুলোকে বলা হয় চিপস। চিপসগুলো প্রায় এক মাস ড্রাম বা চৌবাচ্চায় পানিতে ভিজিয়ে রেখে পচানো হয়। তারপর সেগুলো বয়লার বা স্টিলের ডেকচির মধ্যে রেখে ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে জ্বাল দেওয়া হয়। তখন ডেকচি থেকে পাতন পদ্ধতিতে ফুটন্ত পানিগুলো বাষ্প হয়ে একটি নলের মাধ্যমে ফোঁটায় ফোঁটায় জমা হয় বখরা নামের নির্দিষ্ট পাত্রে। সেগুলো ফিল্টার করে উৎপাদন হয় কাঙ্ক্ষিত আতর। প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ফালি থেকে গড়ে ২০ তোলা আতর বের হয়।

আগর গাছের পাতা আর বাকল ছাড়া বাকি পুরো অংশই কাজে লাগে। পেরেক লাগানোর পর যে অংশটুকু কালো আকার ধারণ করে সেটিকে বলা হয় আগর। একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ থেকে দুই থেকে তিন কেজি আগর কাঠ পাওয়া যায়। এ কাঠ ধুপের মতো জ্বালিয়ে তা থেকে সুগন্ধি তৈরি করা হয়। এটি থেকে আতরও তৈরি করা যায়। যেটি খুবই দামি। গাছের পুরো সাদা অংশ থেকে শুধু আতর উৎপাদন করা যায়। আতর উৎপাদনের পর বর্জ্য চিপসগুলোও রপ্তানি করা হয়।

মানভেদে আগরের কেজি রপ্তানি হয় সর্বনিম্ন ১৫০ ডলার থেকে সাড়ে চার হাজার ডলারে। প্রতি লিটার আতর রপ্তানি হয় তিন থেকে ১৪ হাজার ডলারে। বর্জ্য চিপসের কেজির রপ্তানিমূল্য চার থেকে ৩০ ডলার।

রপ্তানিতে বড় উত্থান
বিস্ময়কর উত্থান ঘটছে আগর-আতর রপ্তানিতে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক লাখ ৬৫ হাজার ৬৮৮ ডলারের আগর-আতর রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর পরের ২০২০-২১ অর্থবছরে বড় লাফ দিয়েছে রপ্তানি। ওই বছর রপ্তানি হয়েছে ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭২৩ ডলারের। এরপর যথাক্রমে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৯ লাখ ২৪ হাজার ২৬৮, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ সময় ১ কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ২১১ ডলার রপ্তানি আয় এসেছে আগর-আতর শিল্পের হাত ধরে। সর্বশেষ চলতি  ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রপ্তানি হয়েছে ৫১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩৯ ডলারের পণ্য। 

রপ্তানি গন্তব্য
ইপিবির তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতে। দেশটিতে গত ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩৬ লাখ ২১ হাজার ডলারের পণ্য। এছাড়াও রপ্তানি হচ্ছে সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, তানজানিয়া, ভারত, আয়ারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও নিউ তাইওয়ানে।
যা চান উদ্যোক্তারা

আগে সরাসরি রপ্তানি হতো না আগর-আতর। রপ্তানি হতো প্যাসেঞ্জার লাগেজ পদ্ধতি বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। ২০ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণার পর সরাসরি রপ্তানি শুরু হয়। গত বছর প্রণোদনা কমিয়ে ৮ শতাংশে নামানোর কারণে রপ্তানি কাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়ছে না। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৩০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনতে হয়। গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় নতুন করে কেউ উৎপাদনে আসতে পারছে না। অভাব রয়েছে পর্যাপ্ত মূলধনের। বেশির ভাগ কারখানা ছোট। তাদের পক্ষে রপ্তানি করা সম্ভব নয়। আগর শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।

মা আগর-আতর এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুল আজিজ সমকালকে বলেন, এসএমই ফাউন্ডেশন স্বল্পসুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিলে উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। মাসিক নয়, তিন মাস পরপর কিস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনসারুল হক বলেন, রপ্তানি বাড়াতে সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি উদ্যোগ দরকার। আগের মতো প্রণোদনা ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

তিনি বলেন, আগর দিয়ে ইউরোপে ওষুধ, সাবান, শ্যাম্পুসহ নানা সুগন্ধি পণ্য তৈরি হয়। দেশে এগুলো উৎপাদনের জন্য গবেষণা দরকার। গত বছর গবেষণার জন্য ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো গবেষণা হয়নি। শিল্পের উন্নয়নে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

গ্যাসের তীব্র সংকট রয়েছে উল্লেখ করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক কবির আহমদ চৌধুরী বলেন, অনেকে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন। ফলে খরচ বেড়ে গেছে। পণ্য জাহাজীকরণের ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বন বিভাগ ও কৃষি অধিদপ্তরের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লেগে যায়। এসব সমাধান করতে হবে।

মজুরি কম
কোটি ডলারের আগর-আতর রপ্তানি হলেও ন্যায্য মজুরি নেই শ্রমিকের। একজন শ্রমিক দৈনিক তিনটি গাছে পেরেক বিঁধতে পারেন। তাতে মজুরি পান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। যারা ফালি করা কাঠ কেটে ছোট ছোট চিপস তৈরি করছেন তাদের দৈনিক মজুরি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। চিপস তৈরির শ্রমিক জহিরুন বেগম বলেন, বছরে ছয় মাস কাজ থাকে। মজুরিটা একেবারেই কম।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সুজানগরেই গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র আগর-আতর ক্লাস্টার। যেখানে প্রায় ২৫ শতাংশই নারী শ্রমিক। ক্লাস্টারের বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। সংস্থাটি জানিয়েছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি ৪১ উদ্যোক্তাকে স্বল্পসুদে প্রায় দুই কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। 

মৌলভীবাজারে আগর-আতর কারখানার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। এসএমই ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ওই ক্লাস্টারে ছোট-মাঝারি শতাধিক কারখানা রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, কারখানা রয়েছে ২০০ থেকে ২৫০টি। এছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানে আছে আরও ৫০টির মতো। যদিও বন বিভাগের তথ্যমতে, নিবন্ধিত কারখানা ১৭৬টি। 

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বন বিভাগের নিজস্ব নীতিমালা আছে। সেগুলো ডিঙ্গিয়ে কিছু করা যাবে না। উদ্যোক্তাদের কাঁচামাল সংকট নিরসনে বন বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ক্রেতা দেশে চড়া শুল্ক কমানোর বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d