Hot

তারা সাংবাদিক নন সাংঘাতিক!

রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়ায় জমির মালিকানা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধ চলছে মোছা. নার্গিসের। তাঁর সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার আশ্বাস দেন সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া মো. নুরুজ্জামান। তিনি আরেক কথিত সাংবাদিক সেলিম নিজামীকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন। এর পর তারা ডিবিপ্রধান ও ডেমরা থানার ওসিকে ম্যানেজ করার কথা বলে নেন পৌনে ৪ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান তারা দেননি। তবে চাপে পড়ে ফেরত দিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। এ ঘটনায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে বিচার দিয়েছেন ভুক্তভোগী। 

ডেমরার দুর্গাপুরে নির্মাণাধীন এক বাড়ির মালিকের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন সাংবাদিক পরিচয়ধারী বজলুর রহমান। তিনি বলেন, রাজউকের নিয়ম না মেনে বাড়ি বানানো হচ্ছে। দু’দিনের মধ্যে বাড়ি ভেঙে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তিনি বিভিন্নজনের মাধ্যমে বাড়ির মালিক সুজন চন্দ্র রায়কে টাকার জন্য চাপ দেন। এতেও কাজ না হওয়ায় তিনি এক সাংবাদিককে দিয়ে রাজউকে অভিযোগ করান। এত হম্বিতম্বি করেও অবশ্য টাকা হাতিয়ে নিতে পারেননি। কারণ, ভবন মালিকের পাশে ছিলেন তাঁর আত্মীয় আরেক সাংবাদিক। 

এমন ঘটনা শুধু এই দুটিই নয়। সাংবাদিক নামধারী চাঁদাবাজ-প্রতারকের দাপটে অতিষ্ঠ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ। এর মধ্যে ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর ও কদমতলী এলাকায় তাদের দৌরাত্ম্য বেশি। তারা কখনও রাজউক কর্মকর্তা, কখনও মানবাধিকারকর্মী, কখনও কলকারখানা পরিদর্শক, আবার কখনও সাংবাদিক পরিচয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ ব্যবসায়ী ছাড়াও মাদক কারবারিদের কাছ থেকে চাঁদা নেন তারা। চাঁদা না দিলে ছবিসহ খবর প্রকাশের ভয় দেখান। কখনও আবার অনিয়মিতভাবে প্রকাশ হওয়া অখ্যাত পত্রিকায় উল্টাপাল্টা খবর ছেপে দেন। কাউকে হয়রানি করতে নিজেরাই মামলা করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস সমকালকে বলেন, সাংবাদিক নামধারী কিছু লোকের বিরুদ্ধে প্রায়ই নানা অপকর্মে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে অনেক সময় মামলা নেওয়া হয়। আবার মীমাংসাও হয়ে যায়। মূলত পশ্চাৎপদ যেসব এলাকায় মূলধারার গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের পদচারণা কম, সেখানেই তাদের দৌরাত্ম্য। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করে চলা এদের অনেকেই কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত নন। তারা ইচ্ছামতো পরিচয়পত্র বানিয়ে নেন। আবার কেউ নামমাত্র কোনো অখ্যাত পত্রিকায় যুক্ত। সেই প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র তাদের চাঁদাবাজির হাতিয়ার। এরা এলাকাভিত্তিক কিছু প্রেস ক্লাব গড়ে তোলেন, যা মূলত তাদের ধান্দাবাজির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর প্রেস ক্লাবের কমিটির বিভিন্ন পদই হয়ে ওঠে তাদের মূল পরিচয়। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব থাকার পরও গড়ে উঠেছে ডেমরা প্রেস ক্লাব, শ্যামপুর প্রেস ক্লাব, জুরাইন প্রেস ক্লাব, কদমতলী প্রেস ক্লাব ও ঢাকা সিটি প্রেস ক্লাবের মতো সংগঠন।

যেভাবে টাকা হাতিয়ে নেন সেলিম ও নুরুজ্জামান
সারুলিয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগী নার্গিস বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলাম। ওই সময় সাড়ে ৬ কাঠা জমি কেনার জন্য ভাই গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর কাছে টাকা পাঠাই। কিন্তু তিনি অর্ধেক জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন। পরে কৌশলে আমার সই নিয়ে পুরো জমিই তাঁর নামে করে নেন। এ ছাড়া বিদেশে থাকতে প্লট কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলাম। সেটাও নিজের নামে নেন তিনি। এগুলো নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় আমি ডেমরা থানায় জিডি করি। এর পর সাংবাদিক নুরুজ্জামান আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সমস্যা সমাধানের কথা বলে তিনি সেলিম নিজামীকেও আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে নুরুজ্জামান পৌনে ৪ লাখ টাকা নেন। এর মধ্যে ২ লাখ দেন সেলিমকে। তবে তারা কোনো কাজই করেননি।’ 

স্থানীয়রা জানান, ডেমরা প্রেস ক্লাবের সভাপতি পরিচয় দেওয়া সেলিম নিজামীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সেলিম নিজামীর মোবাইল ফোনে দু’দিন কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে নুরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

রাজউক কর্মকর্তার ভূমিকায় বজলুর
দৈনিক সকালের সময়ের স্টাফ রিপোর্টার পরিচয় দেওয়া বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। অনিয়মের ধুয়া তুলে কোথাও ভবন নির্মাণ শুরু হলে চাঁদা দাবি, বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে চাঁদা দাবি, এমনকি সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে ওএমএসের পণ্য কিনে গুদামজাত করে বেশি দামে বিক্রির ঘটনাও রয়েছে। আমুলিয়ার একটি গুদাম থেকে এই চক্রের মজুত পণ্য উদ্ধারের ঘটনায় ডেমরা থানায় মামলা হয়। 

ভবন নির্মাণে চাঁদা দাবির ঘটনায় ভুক্তভোগী সুজন চন্দ্র রায় বলেন, ‘দুর্গাপুরে জায়গা কিনে দোতালা বাড়ি নির্মাণ করছি। বজলুর রহমান সেখানে গিয়ে ভবন ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। মিথ্যা অভিযোগ করে রাজউক কর্মকর্তাদের পাঠালেও তারা এসে কোনো অনিয়ম পাননি। তবে ওই সাংবাদিককে দু-এক লাখ টাকা দিয়ে ঝামেলা মোটাতে বলেছেন।’ 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বজলুর রহমান বলেন, ‘রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই উনি বাড়ি নির্মাণ করছিলেন। সেখান থেকে ইট পড়ে একজন আহত হন। তাই জনস্বার্থে আমি সেখানে যাই। তবে চাঁদা দাবির অভিযোগ সঠিক নয়। রাজউকে অভিযোগ দিয়েছে এক ছোট ভাই।’

সমকালের কাছে থাকা এক ভিডিওতে দেখা যায়, পণ্যের গুদামে দাঁড়িয়ে বজলুর বলছেন, ‘পুলিশ লইয়া আমার চেয়ে বেশি তো এ দেশে কোনো সাংবাদিক খেলতে পারে না। … ওসিরে এক দিনের মধ্যে মানববন্ধন কইরা, এক দিনের মধ্যে ল্যাংটা কইরা টুপি পিন্দাইছি না?’
 
‘হানি ট্র্যাপ’ চক্রে সাংবাদিক
হানি ট্র্যাপ বা নারীদের দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে অর্থ হাতানো চক্রেও জড়িত ভুয়া সাংবাদিকরা। ৫ মার্চ যাত্রাবাড়ীর কাজলারপাড় এলাকায় এমন একটি ঘটনা ঘটে। সেখানে এক বাড়িতে দুই তরুণীর সঙ্গে দেখা করতে যান দুই যুবক। এর পরপরই দেশ মানচিত্র নামে একটি পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া ফরহাদ খান আকাশসহ চক্রের সদস্যরা হাজির হন। তারা তরুণ-তরুণীর ছবি তোলেন, ভিডিও করেন। মোটা অঙ্কের টাকা না পেলে সেগুলো প্রকাশের ভয় দেখান। এক পর্যায়ে দুই যুবককে মারধর করে তাদের কাছে থাকা ৬৭ হাজার টাকা কেড়ে নেন। 

যাত্রাবাড়ী থানার এসআই কাওসার আহমেদ টিটু বলেন, এ ঘটনায় ৮ মার্চ মামলা হলে আকাশসহ চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আকাশ ছিলেন গাড়িচালক, পরে তিনি সাংবাদিক পরিচয়ে প্রতারণায় নামেন। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক-সংক্রান্ত মামলাও আছে।

মাদক কারবারির কাছ থেকে টাকা নেন তারা
ভুয়া সাংবাদিকের আখড়া যেন যাত্রাবাড়ী-শ্যামপুর এলাকা। এসব এলাকায় একাধিক প্রেস ক্লাব রয়েছে। জুরাইন রেলগেটের অদূরে একটি ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে শ্যামপুর থানা প্রেস ক্লাব। সেখানে জমিজমা-সংক্রান্ত জটিলতার ভুক্তভোগী সেজে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তখন ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দেওয়া মো. হামিম দাবি করেন, পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ও যাত্রাবাড়ী থানার ওসি তাঁর কথার বাইরে যান না। তাই সহজেই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। শুধু এজন্য কিছু খরচ করতে হবে। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ীর ছনটেক এলাকার মাদক কারবারি নাজমা বেগম দিনে ৩০-৪০ হাজার টাকার ইয়াবা, গাঁজা বিক্রি করেন। এর প্রায় অর্ধেকই লাভ। সেই টাকায় ভাগ বসান নামধারী কিছু সাংবাদিক। নাজমা ছাড়াও অন্য মাদক কারবারি, মাছ ও সবজির আড়ত থেকেও নিয়মিত টাকা নেন তারা। তাদের মধ্যে আছেন রাজু আহাম্মেদ, মোস্তফা সেলিম ওরফে আলমগীর সেলিম ও নিবিড়। 
মাদক কারবারি নাজমা জানান, সাংবাদিকরা একেকজন তাঁর কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ টাকা, অর্থাৎ মাসে ২ হাজার টাকা করে নেন। 

সবুজ বাংলাদেশের রিপোর্টার পরিচয় দেওয়া রাজু আহাম্মেদ দাবি করেন, একসময় পুলিশের হয়রানি থেকে নাজমাকে রক্ষা করতেন তিনি। তখন চা-নাশতা খাওয়ার জন্য ১০০ টাকা করে নিতেন। তবে এখন সেখান থেকে সরে আসার পরও তাঁর নামে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। 

ইয়াবা কারবারেও নামধারী সাংবাদিক
সাংবাদিকের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে ইয়াবার কারবারও চালান কেউ কেউ। তাদেরই একজন রাকিবুল ইসলাম। তিনি দৈনিক আশ্রয় প্রতিদিনের রিপোর্টার পরিচয়ে চলাফেরা করতেন। এর আড়ালে ইয়াবা বিক্রি ছিল তাঁর পেশা। গত ২৪ ডিসেম্বর সায়েদাবাদ এলাকায় ৩ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d