তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা জামায়াতের

কূটনীতিতে সরব হয়ে উঠেছে জামায়াত। টার্গেট বিশ্বদরবারে দলের পজিটিভ ইমেজ তৈরি করা। সম্প্রতি কূটনৈতিক অঙ্গনে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং তাৎপর্যপূর্ণ তৎপরতা দেখা যায় দলটির।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ তকমায় একসময় কোণঠাসা জামায়াত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পায়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে দলটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের এই কূটনৈতিক তৎপরতা তাৎপর্যবহ বলে মনে করছেন অনেকেই।
সূত্রমতে, রাজধানীর বড় মগবাজার জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রায় প্রতিসপ্তাহে একাধিক দেশের কূটনীতিকের যাতায়াত এবং দলের আমীরসহ শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে পর্যবেক্ষক মহলের নজর কেড়েছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহটি ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ সপ্তাহে রাশিয়া, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়া, জাতিসংঘ, পাকিস্তান, ফিলিস্তিনসহ সাতটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াতের আমীর এবং শীর্ষ নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ- মতবিনিময় হয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ফিলিস্তিনি কূটনীতিকদের এক বছরের মধ্যে এটা দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হলো।
জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক মহলের এমন ধারাবাহিক সাক্ষাৎ এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সম্পর্কে দলের সহকারী সেক্রেটারি ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নানা কারণে জামায়াতের ব্যাপারে বিদেশিদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে সম্প্রতি জামায়াত আমীরের অসুস্থতার কারণে অনেকেই তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে যাচ্ছেন। এসব সাক্ষাৎ রাজনৈতিক তাৎপর্যবহ কি-না এমন প্রশ্নে ড. আযাদ বলেন, তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা একটি দলের প্রধান, তাই যে কোনো সাক্ষাতে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসাটা স্বাভাবিক। সে হিসেবে এসব সাক্ষাতে রাজনৈতিক তাৎপর্য অবশ্যই আছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঐতিহাসিক ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাতারাতি পাল্টে যায় ৫০৫ বড় মগবাজারে জামায়াতের দলীয় কার্যালয়ের চিত্র। একের পর এক আগমন ঘটে বিদেশি মেহমানদের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শীর্ষ নেতাদের বিদেশ সফর। ইতিমধ্যে দলের আমীর ডা. শফিকুর রহমান ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীনসহ একাধিক দেশ সফর করেছেন। বসে নেই নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদসহ শীর্ষ নেতারা।
গত এক বছরে অন্তত ৩০টি দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও কূটনীতিকের সঙ্গে নিবিড় বৈঠক করেছেন দলের আমীরসহ শীর্ষ নেতারা। ধারাবাহিক এসব তৎপরতার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের নতুনভাবে তুলে ধরছে জামায়াত। তারা প্রমাণ করতে চাইছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জামায়াত সম্পর্কে যেসব বার্তা দেয়া হয়েছে, সেগুলো ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’ ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি আতাউর রহমান সরকার বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই জামায়াতে ইসলামীকে ‘জঙ্গি, উগ্রবাদী, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীসহ নানা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে। এসব প্রোপাগান্ডার মুখে সংগঠনটিকে কোণঠাসা করে রাখার নীতি ছিল আওয়ামী সরকারের। সময়ের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে ওইসব অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দিচ্ছে জামায়াত। এরই মধ্যে শক্তিশালী করা হয়েছে জামায়াতের কূটনৈতিক উইংকে।
দলীয় সূত্রমতে, জুলাই বিপ্লবের পর কূটনীতিকদের মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সর্বপ্রথম জামায়াত অফিস পরিদর্শন ও একান্ত বৈঠক করেছেন। ২০২৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। এ সময় চীনা দূতাবাসের ডেপুটি অ্যাম্বাসাডরসহ আরও দু’জন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। গত ৮ই অক্টোবর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক। তিনিও জামায়াতের আমীর ও শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত ১৪ই অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে আমীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) নার্দিয়া সিম্পসন। গত ১৬ই অক্টোবর ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ সালেহ ওয়াই রামাদান জামায়াতের আমীরসহ শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত ২৬শে নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রামিস সেন। গত ১০ই ডিসেম্বর ইরানের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি জামায়াত আমীরের সঙ্গে দেখা করেন। গত ১৩ই জানুয়ারি আমীরের সঙ্গে দেখা করেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত পাওলো ফারনান্দো দিয়াস ফেরেস। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসেফ ঈসা আল দোহাইলানের সঙ্গে সৌদি দূতাবাসে গিয়ে দেখা করেন জামায়াতের আমীর। গত ১১ই ফেব্রুয়ারি জামায়াতের আমীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। গত সপ্তাহে আবারও পাকিস্তানের হাইকমিশনার জামায়াত আমীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। গত ১০ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ড্যানিলোভিচ জামায়াতের আমীরের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। গত ১১ই মার্চ আমীরের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। গত সপ্তাহেও কুক জামায়াত আমীরের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎ করেন। একইভাবে ১৩ই মার্চ জামায়াত আমীরের সঙ্গে বৈঠক করেন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার জি খোজিন। গত বৃহস্পতিবার জামায়াত আমীরের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বৈঠক হয় তার।
উল্লেখ্য, গত ২৪শে আগস্ট পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের শুভেচ্ছা নিয়ে জামায়াত আমীরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় যান। এছাড়া গত সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার জি খোজিন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার সুসান রাইল, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ সালেহ ওয়াই রামাদান জামায়াত আমীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।