Bangladesh

তিন বছর ধরে পণ্যের দাম নির্ধারণ নিয়ে ধোঁকাবাজি: বাজার অব্যবস্থাপনার চরম খেসারত দিচ্ছে ভোক্তা

নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে চরম অরাজকতা। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, ডিম, আলু ও পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্যের দামে আগুন। বেশ কিছু পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে গত তিন বছরে কয়েক ধাপে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু বাস্তবে তা থেকে গেছে কাগজে-কলমে। ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্তকে বরাবরই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে।

পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এক প্রকার নির্বিকার। ফলে মূল্য নির্ধারণের পরও পণ্যের বাড়তি দাম নিচ্ছে অসাধু মুনাফাখোরী ব্যবসায়ীরা। বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত দেশের সব শ্রেণির মানুষ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজার অব্যবস্থাপনার চরম খেসারত দিচ্ছেন ভোক্তা।

মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। সরকার তখন নানা উদ্যোগ নেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এ দাম নির্ধারণের আগেই একেকটি পণ্যের দাম যত টাকা বাড়ানো হয়েছিল, তা থেকে পুরোটা না কমিয়ে সামান্য কিছু কমানো হয়। এমনকি উৎপাদন, পরিবহণ, ব্যবসায়ীর মুনাফাসহ যে দাম হওয়ার কথা, এর চেয়েও বেশি দাম নির্ধারণ করা হয়। এতে করে ভোক্তার কোনো উপকারই হয়নি।

দেশে এখনো অনেক গরিব মানুষ ভাতের ওপর চাপ কমাতে আলুর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই গরিবের আলু নিয়েও চলছে অরাজকতা। আলুর পাশাপাশি ডিম ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এ বছরের শুরুর দিকে আলুর কেজি ছিল ২০ টাকা। মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ টাকা কেজি। প্রায় দুমাস ধরে প্রতিকেজি আলু ৫০-৫৫ টাকায় কিনতে হয় ভোক্তাকে। বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কায় ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিকেজি আলুর খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজারে এই আলু এখনো ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা নির্ধারিত দাম মানেনি। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও আলুর দাম কমানো হয়নি।

অন্যদিকে চলতি বছরের মার্চে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা। মে মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ টাকা। পরিস্থিতি এমন যে, এই পেঁয়াজ অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে ১০০-১১০ টাকা বিক্রি করে। পেঁয়াজের এই কারসাজি রোধে ১৪ সেপ্টেম্বর কিছুটা মূল্য কমিয়ে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজারে এখনো পেঁয়াজ ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতি পিস ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা। মে মাসে তা বেড়ে হয় ১১ টাকা। এখন এই ডিম পিসপ্রতি ১৪-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও সরকার প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করেছিল।

এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খোলা চিনির কেজি ছিল ৯০ টাকা। চলতি বছরের মে মাসে দাম বেড়ে হয় ১৩৫ টাকা। এর এক মাসের মধ্যেই কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে অর্থাৎ জুনে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। যদিও সরকার কেজিপ্রতি চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৩০ টাকা। কিন্তু সেই দামও মানা হচ্ছে না। বাজারে এখনো বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়।

বাজার ব্যবস্থাপনায় এই যে অব্যবস্থাপনা-এর প্রতিকারের উপায় কী এমন প্রশ্নে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর করছেন না। এমনকি অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে। মূল্য নির্ধারণ করার পর তা না মেনে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করায় ক্রেতার বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে। এতে ক্রেতাদের চরম খেসারত দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকিতে নিয়োজিত। কিন্তু তাদের সমন্বিত তদারকির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই অবস্থা থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর দিকেই মিলাররা চাল নিয়ে কারসাজি শুরু করে। পরিস্থিতির সুযোগ বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগায় তারা। বাড়াতে থাকে সব ধরনের চালের দাম। মিলারদের কারসাজি রোধে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বৈঠকও করেন। তখন সবচেয়ে ভালো মানের ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম মিলগেটে ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের মধ্যে বিআর-২৮ চালের দাম ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তখন এই বেঁধে দেওয়া দাম মিল পর্যায়ে মানা হয়নি। সে সময় মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা বিআর-২৮ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা। সেই থেকে তিন বছর ধরেই সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম না মানার প্রতিযোগিতায় আছে ব্যবসায়ীরা।

ওই সময় (২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস) আলুর পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও অসাধুদের কারসাজিতে হঠাৎ করেই অস্থির হয় আলুর বাজার। তখনো খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু সর্বোচ্চ ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রথম দফায় ৭ সেপ্টেম্বর হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। পরে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে ২০ অক্টোবর দাম পুনর্নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সেক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ৩৫ টাকা, কোল্ডস্টোরেজ বা হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৭ টাকা এবং পাইকারিতে ৩০ টাকা করা হয়। কিন্তু সে সময়ও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৩৫-৪০ টাকায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হিমাগার পর্যায়ে আলু বিক্রি হয় ৩৩-৩৬ টাকায়।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা যায়, ২০২০ সালে সরকার মিল পর্যায়ে খোলা সয়াবিনের দাম ৯০ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন ১৩৫ ও খোলা সয়াবিনের দাম ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তখন বাজারে বোতলজাত সয়াবিন ১৪০-১৪৫ টাকায় ও খোলা সয়াবিন ১২০-১২২ টাকায় বিক্রি হয়।

এছাড়া ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৪৩ টাকা। ওই দরে বাজারে সয়াবিন পাওয়া যায়নি। পরে তা বাড়িয়ে নির্ধারণ হয় ১৬৮ টাকা। ওই দামেও তেল মেলেনি। ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে তেলের দাম কমিয়ে ওই বছরের ২০ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে বোতলজাত সয়াবিন প্রতিলিটারের দাম ১৬০ টাকা ও খোলা সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৩৬ টাকা। তবে বাজারে তখন বোতলজাত সয়াবিন ১৬৫-১৭০ টাকা ও খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ১৫৩-১৫৪ টাকায়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আগে থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেউ অনিয়ম করলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই ভোক্তা সরকারের উদ্যোগের সুফল পাবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। আমি নিজে অভিযান পরিচালনা করে অসাধুদের আইনের আওতায় আনছি। পাশাপাশি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযানে অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির আওতায় আনছে। তবে জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় অসাধুরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তারপরও অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি। পাশাপাশি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অধিদপ্তর কঠোর। যেখানেই সিন্ডিকেট পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই তা ভাঙা হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
bacan4d
bacan4d