তীব্র গরমে ওষুধের গুণগত মান নষ্টের আশঙ্কা
দেশের অর্ধেক ফার্মেসিতে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র
তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। এক সপ্তাহ ধরে দেশের অধিকাংশ জায়গায় তাপমাত্রা ৩৯-৪২ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। কিন্তু অধিকাংশ ওষুধের প্যাকেটে ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নির্দেশনা রয়েছে। দেশের প্রায় অর্ধেক ফার্মেসিতে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। তাই তীব্র গরমে ওষুধের গুণগত মান নষ্টের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করতে ফার্মেসিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফার্মেসিগুলোয় ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে চিঠি দিয়ে তাদের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণে সচেতন হওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিতে কোল্ড চেইন মেইনটেন করা জরুরি। ব্লাড প্রোডাক্ট, ভ্যাকসিন-জাতীয় ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের কিট ৪-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ওষুধ ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা যায়। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে ২ লাখের মতো ফার্মেসি আছে। এর মধ্যে মডেল ফার্মেসি প্রায় ৮০০। ঢাকাসহ সারা দেশে টিনশেড অনেক দোকানে ওষুধ বিক্রি করা হয়, যেগুলোয় এসি বা রেফ্রিজারেটর কিছুই নেই। স্বাভাবিক সময়ে সেসব দোকানের ওষুধের কোল্ড চেইন ঠিকমতো মানা হয় না, সেখানে হিটওয়েভের এই সময়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘দেশে ২ লাখ ফার্মেসির মধ্যে ১ লাখ ফার্মেসিতে এসি (এয়ার কন্ডিশনার) নেই। তাই তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেই কার্যকারিতা কমে যায়।
তাপমাত্রা বাড়ার কারণে রেফ্রিজারেটরে রাখতে হয় এমন ওষুধ কার্যকারিতা হারাবে। এগুলো মূল্যবান এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অনেক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ থাকছে না, সে কারণে রেফ্রিজারেটরে রাখা ওষুধও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফার্মেসি মালিকদের তো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কিন্তু বাসায় ওষুধের মান ঠিক রাখতে মানুষকে সচেতন হতে হবে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের বাসায় রাখা ওষুধ আগামী এক সপ্তাহে তুলনামূলক কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওষুধ সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হবে। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা প্রয়োজন এমন ওষুধ মাইনাস ৪-২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হবে। দেশে জাতীয় ওষুধ নীতিতেও ওষুধের দোকানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং রেফ্রিজারেটর থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে ওষুধের দোকানের নিবন্ধন দেওয়ার বিধান নেই। তবে বাস্তবে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যে কোনো ওষুধ বাজারে আনার আগে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ও ৭৫ শতাংশ হিউমিডিটি পর্যন্ত রেখে স্থিতিশীলতা পরীক্ষা (স্ট্যাবিলিটি স্টাডি) করা হয়। এ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয়, এ তাপমাত্রায় ওষুধের স্ট্যাবিলিটি কতটা, তারপর মেয়াদ ঠিক করা হয়।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ফার্মাসিউটিক্যাল প্রফেশনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. এ এস এম আনছারুল ইসলাম বলেন, ‘ওষুধের প্যাকেটের গায়ে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেওয়া থাকে। আমরা ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ওষুধ রেখে গবেষণা করি। কিন্তু এখন হিটওয়েভের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি ১৫-২০ দিনের বেশি চললে প্রোডাক্টে দুই রকমের সমস্যা হবে। সিরাপের রং নষ্ট হয়ে যাবে, ক্যাপসুলের শেড নরম হয়ে যাবে এবং দীর্ঘস্থায়ী গরমের কারণে প্রোডাক্টের কার্যকারিতা কমে যাবে।’
সুপ্রিম ফার্মাসিউটিক্যালসের এই এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আরও বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো ফ্রিজিং কাভার্ড ভ্যানে ওষুধ ডেলিভারি দেয়, কিন্তু দোকানে যাওয়ার পর ফার্মেসির দায়িত্ব তা নিয়ন্ত্রণ করা। যদিও অধিকাংশ ফার্মেসি তা করে না। মডেল ফার্মেসিতে এসি, রেফ্রিজারেটার থাকে, কিন্তু দেশে মডেল ফার্মেসি অনেক কম। ওষুধের দোকানগুলো যথাযথ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করছে কি না মনিটরিং করার দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। যে দোকানে ফ্যান, এসি, ফ্রিজ আছে সেসব দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হবে।’