Trending

ত্রাণ কেউ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না

উজান থেকে আসা ঢলে ভেসে গেছে ফেনী। ছয়টি উপজেলার কোনোটিই রক্ষা পায়নি। গত কয়েকদিনে উন্নতি হয়েছে পরিস্থিতি। রাস্তাঘাট শুকিয়েছে। প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কার্যক্রমও স্বাভাবিক হয়েছে। তবে বন্যাকবলিত অনেক এলাকার মানুষ এখনও পানিবন্দি। এসব এলাকায় ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন অনেকে। গতকাল সকালে ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বিরলী, রতনপুর, জয় নারায়ণপুর, রামচন্দ্রপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমন্বয়য়ের অভাবেই সর্বত্র ত্রাণ মিলছে না।

বিজ্ঞাপন যদিও জেলা প্রশাসন সমন্বয়হীনতার কোনো অভিযোগ নেই বলেই জানিয়েছে। 

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বিরুলী গ্রামের বাসিন্দা বিবি কুলসুম জানান, নয়দিন ধরে ঘরে পানিবন্দি থাকায় পার্শ্ববর্তী একটি দোতলা ভবনে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন আধা কেজি চিড়া ও আধা কেজি মুড়ি ছাড়া কোনো কিছু পাইনি। 
একই কথা বলেছেন গ্রামের নৌকাঘাট এলাকার তোফাজ্জল হোসেন, আনোয়ার হোসেন, লাইলী বেগম, আবুল খায়ের ও বিবি মরিয়ম । কমবেশি সবার ঘরেই এখনো হাঁটু সমান পানি।  আশ্রয় নিয়েছেন বিরলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। 

রওশন আরা নামে পঞ্চাশোর্ধ এক নারী বলেন, দুপুরে রান্না করা খাবার একবেলা দিয়ে যায়। আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে বাকি দুই বেলা চিড়া মুড়ি খেয়ে থাকতে হচ্ছে । পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি না থাকায় বুক পরিমাণ পানিতে ডুবে উঁচুস্থানের একটি কল থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। বিরলী গ্রামের নৌকাঘাট এলাকার পপি আক্তার বলেন,  বন্যার পর থেকে গত আটদিনে ছয়টি মোমবাতিও ৫ লিটারের এক বোতল পানি পেয়েছি। এ ছাড়া এর মধ্যে আর কোনো সামগ্রী পাইনি। ঘরে যা শুকনো খাবার ছিল তা খেয়েছি। খাবার শেষ হওয়ার পর পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে মুড়ি বিস্কুট কিনে কয়েকদিন ধরে খেয়েছি। রান্নার চুলা পানিতে ডুবে থাকায় এখনো ভাত রান্না করতে পারেননি বলেও জানান তিনি। একই কথা বলেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া আছিয়া খাতুন। চিড়া মুড়ি খেয়ে কয়দিন থাকা যায় আমাদের কেউ চাল ডাল সহযোগিতা করেনি এখনো। এ গ্রামে চাল ডাল নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনকে আসার জন্য অনুরোধ করেছেন ।

রিকশাচালক শাহ আলম বলেন , ঘরে এখনো হাঁটু পরিমাণ পানি । উঠানে বুক পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে উপার্জনের একমাত্র বাহন রিকশাটি । ৮-৯ দিন রিকশা চালাতে না পারায় উপার্জন বন্ধ রয়েছে । ওই বাড়ি পেরিয়ে একটু সামনে এগোতে হাতে বালিশ কাঁথা নিয়ে হাঁটছিলেন বৃদ্ধ আমিনুল ইসলাম । তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে হাঁটু পরিমাণ পানি থাকলেও বর্তমানে মেঝেতে পানি রয়েছে। এ সময় ঠিকমতো খাবার না পাওয়ার অভিযোগ করেন তিনি। এদিকে পার্শ্ববর্তী রতনপুর গ্রামে ঘুরে দেখা যায় গ্রামের গ্রামীণ সড়কগুলোতে এখনো হাঁটু পরিমাণ পানি। পানিবন্দি মানুষগুলো ছোট ডিঙ্গি নৌকা ব্যবহার করে যাতায়াত করছে। গ্রামের বাসিন্দা মো. বেলাল হোসেন বলেন, আটদিন ধরে তারা পানিবন্দি রয়েছেন। বাড়িতে থাকা ফ্রিজ টিভিসহ মূল্যবান আসবাব নষ্ট হয়ে গেছে। 

স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক শাহজালাল ভূঁইয়া বলেন, গত বুধবার থেকে টানা নয়দিন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বাজারে কিছু কিছু জায়গায় জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ায় গ্রামবাসী টাকা দিয়ে লাইন ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে মোবাইলে চার্জ দিচ্ছেন। বন্যাকবলিত এই পরিস্থিতি পার্শ্ববর্তী বক্তারপুর, জয় নারায়ণপুর, রামচন্দ্রপুর, নুরুল্লাহপুর, রাজাপুর ঘোনাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতেও বিরাজ করছে। 

ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের অভাব: ফেনীতে বন্যা শুরুর পর থেকে সারা দেশ থেকে সরকারি বেসরকারিভাবে ত্রাণ আসা শুরু হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় অনেক জায়গায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাচ্ছে না।  ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ত্রাণ শাখায় দায়িত্বরত এক স্বেচ্ছাসেবক জানান, গত শুক্রবার থেকে টানা ৫দিন ত্রাণ শাখার দায়িত্বে ছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাকে করে আসা ত্রাণগুলো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় মজুত হলেও সরকারিভাবে বিতরণের সমন্বয়হীনতার কারণে অনেকে ত্রাণ পায়নি। গত বুধবার থেকে প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।

টিম ইজিলাইফ’র স্বেচ্ছাসেবক শহিদুল মিশু বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় রান্না করা খাবার পাঠিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে সাহায্য করা হচ্ছে। বন্যা পরবর্তী সময় মোকাবিলা করার জন্য চাল,ডাল, তেল বিতরণ করে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যারা সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন মহিউদ্দিন রনি বলেন, ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার তথ্য পেয়ে আমিসহ আমাদের টিমের বেশ কয়েকজন ফেনীতে যাই কার্যক্রম পরিচালনা করতে। রাজনৈতিক দলের স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কয়েক দফা আমাদের বিরোধ হয়। পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর অসুস্থতার খবর পেয়ে আমরা টিমসহ ঢাকায় চলে আসি। আমি আবার যাবো ফেনীতে। তবে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সমস্যা হলে সেটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ওপর দায় দেয়া যাবে না।

অবশ্য মহিউদ্দিন রনি গত কয়েকদিনে ত্রাণ কার্যক্রমে এসে ফেসবুক লাইভে বিতরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে ত্রাণ ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগও করেন সেই লাইভে। এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসক মোছা. শাহিনা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, জেলা প্রশাসন ত্রাণ বিতরণে তৎপর রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ত্রাণ ৮৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার, সড়ক ও নৌপথে আরও সাত হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে ।  বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ,  সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থা নিয়মিত ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। জেলা প্রশাসনে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের কোনো অভাব নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button