Bangladesh

ত্রাণ যাচ্ছে না দুর্গম এলাকায়

নতুন করে পানিবন্দি আরও ২ লাখ পরিবার, দুর্ভোগে ফেনী-কুমিল্লা- নোয়াখালীর বানভাসিরা, দুই শিশুসহ আরও পাঁচ জনের মৃত্যু

ফেনী ও নোয়াখালীর দুর্গম এলাকার পানিবন্দি মানুষেরা ত্রাণের অভাবে কষ্টে আছেন। অনেক এলাকায় নৌযান সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে আটকে পড়াদের উদ্ধার অভিযান। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির জন্য বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের হাহাকার। শহরের আশপাশে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হলেও প্রত্যন্ত এলাকায় ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না ত্রাণ। মূলত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও নৌযানের অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণের অভাব তেমন না থাকলেও বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সংকট রয়েছে।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নোয়াখালীতে  নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। খুলনার বটিয়াঘাটায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। প্রবল বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে যশোর শহর। কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ও পানিতে ডুবে দুই শিশুসহ কমপক্ষে আরও পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যায় ১১ জেলায় গত একদিনে নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৪০৬। রবিবার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮ জন। গতকাল সোমবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ জনে। একই সঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ ৯১ হাজার ১৯টি পরিবার নতুন করে পানিবন্দি হয়েছে। এ নিয়ে মোট ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার বর্তমানে পানিবন্দি রয়েছে। বন্যায় গত এক সপ্তাহে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লায় বিপত্সীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে থাকা গোমতী নদীর পানি ধীরগতিতে কমলেও বাড়ছে বাঁধ ভাঙনে প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা। তলিয়ে গেছে জেলার প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম, মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট উপজেলা। পানিতে ডুবে সোমবার সকালে বুড়িচংয়ের পশ্চিম সিংহ গ্রামের আল-আমিনের ছেলে মো. ইব্রাহিম (৪) ও দুপুরে আরাগ আনন্দপুর গ্রামের নুরুল আমিনের ছেলে হাসিবুল ইসলাম (৯) নামের দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

ফেনী-নোয়াখালীতে ত্রাণের জন্য হাহাকার

ফেনীর তিনটি উপজেলার চারদিক পানিতে ভেসে থাকায় গ্রামের দিকের মানুষের খাবারের কষ্টে থাকার কথা জানিয়েছেন একাধিক সংবাদকর্মী। তারা জানান, অনেকে আমাদের কাছে বলছে—দুই দিন ধরে শুকনা টুকটাক খাবার যা ছিল তাই খাচ্ছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পাচ্ছেন না। অনেকের কাছে টাকা আছে, কিন্তু কিনে আনবে ঐ পরিস্থিতিতে তারা নেই। তারা আরো জানান, বন্যার কারণে এখনো অনেক জায়গায় যাওয়া যাচ্ছে না। ঢলের পানির তোড়ে বিভিন্ন স্থানের সড়ক তলিয়ে গেছে। বেশির ভাগ ত্রাণদাতাদের টার্গেট ফেনী সদর ও আশপাশের এলাকার দিকেই, পানিবন্দি প্রান্তিক গ্রামগুলোর দিকে খেয়াল কম। তারা পানির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন, ব্যাপক দুর্ভোগে আছেন। বানভাসি মানুষদের অভিযোগ, পৌরসভার আশপাশে ত্রাণ দিয়েই অনেকে চলে যায়। ভেতরের দিকে কেউ আসে না, তাই এখানকার মানুষ বঞ্চিত।

মনোহরগঞ্জ (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ১১টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। ভোগান্তি বেড়েছে তাদের। একতলা বিশিষ্ট কিছু আশ্রয়কেন্দ্রেও ঢুকেছে পানি। দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী না থাকায় বিপাকে পড়েছেন এ এলাকার বাসিন্দারা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হলে তারা আক্ষেপ করে বলেন, ত্রাণের গাড়ি ঢাকা থেকে ছাড়ে কিন্তু মনোহরগঞ্জ এসে পৌঁছায় না। ঢাকা থেকে যারাই ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কুমিল্লা আসছেন তাদের সবাই কাছাকাছি স্পটগুলোতে আসতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে ত্রাণ।

নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরো  অবনতি হয়েছে।  টানা ভারী বর্ষণ ও  উজানের পানির চাপে  পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা বেড়ে  ২৫ লাখ ছাড়িয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।  জেলা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করতে গিয়ে গতকাল বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুই লাইনম্যান। এরা হলেন জাকির হোসেন (৩৩) ও ইব্রাহিম (২৬)। জেলা শহর ও তার আশপাশের আশ্রয়কেন্দ্রে একাধিকবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা সংস্থা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত  রেখেছে। তবে  গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায়  ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে না পারায় বানভাসি মানুষ  হাহাকার করছে।

বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে যশোর, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল ৯ ঘণ্টা

যশোর অফিস জানায়, ২২৮ মিলিমিটার ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে যশোর শহরের রাস্তাঘাট, নিচু অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়েছে পানি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শহরবাসী। তাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত নালা না থাকা, বিদ্যমান নালার অচলাবস্থা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পৌরসভার অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, রবিবার রাত ১০টা থেকে ভারীবর্ষণ শুরু হয়। চলে সোমবার বেলা ১০টা পর্যন্ত। ২২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) চাঁচড়ার গ্রিড ফেলের সঙ্গে চাঁচড়া উপকেন্দ্রে পানি ওঠায় বন্ধ করা হয় বিদ্যুত্-সংযোগ। ফলে সোমবার ভোর ৪টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় ছিলেন শহরের ৫৫ হাজার গ্রাহক।

বটিয়াঘাটায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি

বটিয়াঘাটা (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের ভগবতীপুর গ্রামে পান্নি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে সোমবার রাতে গ্রামে পানি প্রবেশ করে। সকালে কয়েক গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধের কাজ শুরু করেন। তারা সমস্ত দিন কাজ করে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনলেও যে কোনো মুহূর্তে বাঁধটি আবার ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে এমন আশঙ্কা গ্রামবাসীর। বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরীফ আসিফ রহমান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং গ্রামবাসী বাঁধ মেরামতে কাজ করছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত বাঁধ মেরামত হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

কোম্পানীগঞ্জে রেগুলেটর ভেঙে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে পানি নিষ্কাশন রেগুলেটর ভেঙে পড়েছে। এতে আশপাশের ব্যাপক ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু মুহূর্তে পানির নিচে তলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে উপজেলার প্রায় ৮০টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আমির ফয়সাল বলেন, মুছাপুর রেগুলেটর পানির নিচে তলিয়ে গেলেও বন্যার পানি নিষ্কাশনে কোনে বাধা সৃষ্টি হবে না।

মিরসরাইয়ে সিডিএসপির বাঁধে ফাটল

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে পানি নেমে গেলেও দেখা যাচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো অবস্থান করছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এদিকে মিরসরাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিডিএসপির (চর ডেভেলমমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট)  বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহফুজা জেরিন বলেন, বন্যার পানির চাপে নয়, কেউ অসাধু উদ্দেশে সিডিএসপি বাঁধ কেটে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতের কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ড শুরু করেছে, দুই মাস সময় লাগবে পুরোপুরি মেরামতে।

শাহরাস্তিতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, শাহারাস্তি উপজেলায় উজানের পানিতে গত দুই দিনে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার। উপজেলার সুচিপাড়া ইউনিয়নের অধিকাংশ বাড়িঘর পানির নিচে এবং রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।

চাটখিলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

চাটখিল ও সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, বৃষ্টির কারণে নোয়াখালীর চাটখিলের ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। উপজেলার ৪০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এবং ৯০ ভাগ মাছের প্রজেক্ট ভেসে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ হাজারের অধিক  মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

নাঙ্গলকোটে পানিতে ডুবে মৃত্যু

নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার মোকারা ইউনিয়নের মোড়েশ্বর গ্রামের সিরাজুল হক (৬৫) নৌকাযোগে পার্শ্ববর্তী গোরকমুড়া গ্রামের যাওয়ার সময় স্থানীয় ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ডুবে মারা গেছেন। সোমবার সকালে তার ভাসমান লাশ স্থানীয়রা উদ্ধার করে।

কসবা ও আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, জেলার কসবা ও আখাউড়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। আখাউড়ায় বন্যার পানি বাড়িঘর ও সড়ক থেকে পুরোপুরি নেমে গেছে। কসবাতেও পানি নামা শেষের পথে। তবে বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। গাজীর বাজার এলাকায় সেতু ভাঙার কারণে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button