থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সীমান্ত সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র-চীন যেভাবে যুক্ত

থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনীতে তিন লাখ ৬১ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে, কম্বোডিয়ার তুলনায় যা তিনগুণ। থাই সৈন্যদের হাতে এমন অস্ত্র রয়েছে যা তাদের কম্বোডিয়ান প্রতিপক্ষরা কেবল স্বপ্নেই দেখতে পারে।
কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের নেতারা যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শনিবার এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে তিনি বলেছেন, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর সাথে পৃথক ফোনালাপে দুই দেশ ‘বৈঠকে বসে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং শেষ পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠায়’ সম্মত হয়েছে।
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া মধ্যে বর্তমানে যে সংঘর্ষ চলছে তা শুরু হয়েছিল এক শতাব্দীরও আগে, যখন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারণ করেছিল। বর্তমানে এই প্রাণঘাতী সংঘর্ষে একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র অভিজ্ঞ থাই সেনাবাহিনী, অন্যদিকে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত কম্বোডিয়ার তরুণ সামরিক বাহিনী।
প্রতিদ্বন্দী এই দুই দেশের সামরিক ইতিহাস ও সক্ষমতা কেমন তা দেখে নেয়া যাক।
শক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে থাইল্যান্ড
জনবল ও অস্ত্রশস্ত্রে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী কম্বোডিয়ার তুলনায় অনেক বড়। থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনীতে তিন লাখ ৬১ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে, কম্বোডিয়ার তুলনায় যা তিনগুণ। থাই সৈন্যদের হাতে এমন অস্ত্র রয়েছে যা তাদের কম্বোডিয়ান প্রতিপক্ষরা কেবল স্বপ্নেই দেখতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) ‘মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘থাইল্যান্ডের বিপুল অর্থ বরাদ্দপ্রাপ্ত একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে এবং এর বিমানবাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত বিমানবাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
অপরদিকে, লোয়ি ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের ২৭টি আঞ্চলিক দেশের সামরিক সক্ষমতার র্যাঙ্কিংয়ে থাইল্যান্ডের অবস্থান ১৪। অন্যদিকে কম্বোডিয়া রয়েছে ২৩তম স্থানে।থাইল্যান্ডের জনসংখ্যা কম্বোডিয়ার চার গুণ এবং জিডিপি ১০ গুণেরও বেশি হওয়ায় এই বৈষম্য হয়তো স্বাভাবিক।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আঞ্চলিক যুদ্ধ কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনামকে গ্রাস করেছিল, তবে থাইল্যান্ড সেই যুদ্ধ থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এমনকি পূর্বের ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকেও রেহাই পেয়েছিল দেশটি।
সামগ্রিকভাবে, লোয়ি এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্সে সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে থাইল্যান্ড দশম স্থানে রয়েছে। থাইল্যান্ড ইনডেক্সে ইন্দোনেশিয়ার ঠিক পেছনে কিন্তু মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ফলে একে একটি মধ্যম শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
লোয়ির র্যাঙ্কিংয়ে কম্বোডিয়াকে বিবেচনা করা হয়েছে এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র শক্তি হিসেবে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও লাওসের মতো দেশগুলোর সাথে একই কাতারে অবস্থান করছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশটির ওপর বহু বছর ধরেই সামরিক বাহিনী, রাজতন্ত্র ও অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি রক্ষণশীল শক্তিশালী গোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে।
সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুসারে, ১৯৩২ সাল থেকে সামরিক বাহিনী ২০টি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে, প্রায়শই গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং নিজেদের রাজতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তথ্য অনুযায়ী, থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের একটি চুক্তিভিত্তিক মিত্র। ১৯৫৪ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ম্যানিলা চুক্তি নামে পরিচিত। তখন থেকেই দুই দেশের মধ্যে মিত্রতার সম্পর্ক।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থাইল্যান্ড কিছু বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর সম্পদ মজুত করেছিল, যার মধ্যে ছিল বি-৫২ বোমারু বিমান। হাজার হাজার থাই সেনা মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধও করেছিল। ওয়াশিংটন ও ব্যাংককের মধ্যে এখনো দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রয়েছে। থাইল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র হিসেবে দেখে। এর মাধ্যমে থাইল্যান্ড গত কয়েক দশক ধরে তাদের অস্ত্র কর্মসূচির জন্য মার্কিন সমর্থন পেয়ে আসছে।
এছাড়াও থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে কোবরা গোল্ড নামে একটি বার্ষিক যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে থাকে। ১৯৮২ সাল থেকে এই যৌথ মহড়া শুরু হয়েছিল। পরে আরো অনেক দেশ এই মহড়ায় যুক্ত হয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী অনুসারে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা আন্তর্জাতিক সামরিক মহড়া। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, কোবরা গোল্ড ছাড়াও থাই ও মার্কিন বাহিনী একসাথে ৬০টিরও বেশি মহড়া পরিচালনা করে এবং প্রতি বছর ৯০০টিরও বেশি মার্কিন বিমান এবং ৪০টি নৌজাহাজ থাইল্যান্ডে আসে।
তবে ওয়াশিংটনের সাথে দীর্ঘ সামরিক ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে থাই সেনাবাহিনী সামরিক নীতিতে আরো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করছে এবং গত দশকে তারা চীনের সাথে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। মিলিটারি ব্যালেন্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোনো একটি দেশের ওপর নির্ভর করতে না চেয়ে তারা ইসরাইল, ইতালি, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সুইডেনের মতো দেশগুলোর সহায়তায় একটি শক্তিশালী দেশীয় অস্ত্র শিল্প গড়ে তুলছে।
কম্বোডিয়ার চীনা সমর্থন
আইআইএসএস অনুসারে, ১৯৯৩ সালে কমিউনিস্ট সরকারের বাহিনীর সাথে দুটি অ-কমিউনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনী একত্রিত হয়ে কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনী গঠিত হয়। এটি থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর তুলনায় একেবারেই নবীন।
চীন ও ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ার প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার। একসময় রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা থাকলেও এখন চীন দেশটির প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। বেইজিং কম্বোডিয়ায় একটি নৌঘাঁটিও তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, থাইল্যান্ড উপসাগরে অবস্থিত রিম নৌঘাঁটি চীনা বিমানবাহী রণতরীগুলোকে আশ্রয় দিতে সক্ষম হবে।
কম্বোডিয়া ও চীন গত মে মাসে গোল্ডেন ড্রাগন নামে তাদের বার্ষিক যৌথ সামরিক মহড়া সপ্তমবারের মতো সম্পন্ন করেছে। একে এ যাবতকালের বৃহত্তম মহড়া হিসেবে প্রচার করা হয় এবং এতে তাজা গোলাবারুদ নিক্ষেপের প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পিপলস লিবারেশন আর্মির ইংরেজি ভাষার ওয়েবসাইটে ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদন অনুসারে, চীন-কম্বোডিয়ার সম্পর্কটি এই বছর একটি নতুন স্তরে পৌঁছাবে এবং নতুন উন্নয়ন অর্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল উ কিয়ানকে ফেব্রুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেছিলেন, ‘চীন ও কম্বোডিয়ার বন্ধুত্ব দৃঢ়। তারা সর্বদা একে অপরকে সমর্থন করে। দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও অটল ভ্রাতৃত্ব বিদ্যমান।’
তবে কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনীর সমর্থন প্রয়োজন। আইআইএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম্বোডিয়ার বর্তমানে তার সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আধুনিক সরঞ্জাম তৈরি করার ক্ষমতা নেই।
উভয়পক্ষের অস্ত্রশস্ত্র
আইআইএসএস অনুসারে, বছরের পর বছর ধরে মার্কিন সহায়তায় শক্তিশালী রয়্যাল থাই বিমান বাহিনীর কমপক্ষে ১১টি আধুনিক সুইডিশ গ্রিপেন যুদ্ধবিমান এবং যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত কয়েক ডজন পুরনো এফ-১৬ ও এফ-৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার যুদ্ধ করতে সক্ষম কোনো বিমানবাহিনী নেই।
স্থলভাগে থাইল্যান্ডের কাছে কয়েক ডজন ট্যাঙ্ক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৬০টি আধুনিক চীনা তৈরি ভিটি-৪ ট্যাঙ্ক এবং শত শত পুরনো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ট্যাঙ্ক। মিলিটারি ব্যালেন্সের তথ্য অনুসারে, কম্বোডিয়ায় প্রায় ২০০টি পুরনো চীন ও সোভিয়েতের তৈরি ট্যাঙ্ক রয়েছে।
থাই সেনাবাহিনীর ৬০০টিরও বেশি কামান রয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৫৬টি শক্তিশালী ১৫৫ মিমি অস্ত্র এবং ৫৫০টিরও বেশি ১০৫ মিমি টোয়েড গান রয়েছে। আইআইএসএসের পরিসংখ্যান অনুসারে, কম্বোডিয়ায় মাত্র এক ডজন ১৫৫ মিমি বন্দুক রয়েছে এবং প্রায় ৪০০টি ছোট কামান রয়েছে।
আকাশপথে থাইল্যান্ডের মার্কিন কোবরা হেলিকপ্টার এবং ১৮টি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার রয়েছে। কম্বোডিয়ার কাছে মাত্র কয়েক ডজন পুরনো সোভিয়েত ও চীনা হেলিকপ্টার রয়েছে।
কী হতে পারে সামনে?
ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের সাবেক ডিরেক্টর ও হাওয়াই-ভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক কার্ল শুস্টার বলেছেন, পরিসংখ্যান ও মানের দিক থেকে সামরিকভাবে থাইল্যান্ড এগিয়ে থাকলেও কম্বোডিয়া অন্তত একটি দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, আর তা হলো বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় তাদের ভূগত অবস্থান। কম্বোডিয়ার দিক থেকে বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় প্রবেশে সুবিধা বেশি।
তিনি বলেন, বিতর্কিত এলাকায় কম্বোডিয়ান বাহিনী মাইন ও বিভিন্ন ফাঁদ স্থাপন করায় থাইল্যান্ডকে দূরপাল্লার অস্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে থাইল্যান্ডের বিমানবাহিনী বেশ শক্তিশালী এবং তাদের বিশেষ ফোর্সটি লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠ। থাইরা সংঘাতে বিমান শক্তি ও দূর-পাল্লার অস্ত্রের ওপর জোর দিতে পারে।