দাপুটে আইনজীবীরা আত্মগোপনে কেন?
- গ্রেপ্তার এড়াতে ও মান রক্ষার্থে আদালতমুখী নন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা
- শীর্ষ আইনজীবীদের কয়েকজন এখন আসামির কাঠগড়ায়
- আইন কর্মকর্তা না থাকায় অধস্তন আদালতে বিচারকাজে বিঘ্ন
ল’ইয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট— নানাভাবে আখ্যায়িত আইনজীবীরা। পৃথিবীতে এ পেশার লোকদের শ্রদ্ধার সঙ্গে লার্নেড বা বিজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করা হয়। সংবিধান, আইন, আদালত ও মানবাধিকারের মতো উচ্চ ধারণা এবং জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করেন বলে তাদের দিকে সব শ্রেণির মানুষের দৃষ্টি থাকে। বিচারাকাক্সক্ষীদের পক্ষে তারা আইনি লড়াই চালান। তবে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পাল্টে যায় পরিস্থিতি। কোণঠাসা হয়ে পড়েন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা। একসময়ের দাপুটে আইনজীবীদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে। কেউ কেউ এখন আসামির কাঠগড়ায়। কেউ আছেন কারাগার ও রিমান্ডে। জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামীপন্থি শীর্ষ আইনজীবীদের প্রায় কেউই আদালতমুখী হচ্ছেন না।
তাদের তালিকায় আছেন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর, ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর (প্রশাসন) অ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান বাদল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক, অ্যাডভোকেট আবদুন নূর দুলাল, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম প্রমুখ। বেশ কয়েকজন আইনজীবীর ঘনিষ্ঠজনরা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্মানহানি, মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয় এবং অস্বস্তিতে তারা আদালতে বা প্রকাশ্যে যাচ্ছেন না।
সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকার অধস্তন আদালতে নিয়মিত আইন পেশা পরিচালনা করেন আওয়ামীপন্থি— এমন অন্তত আটজন শীর্ষ আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ ও কথা বলার চেষ্টা করেছেন এই প্রতিবেদক। শুধু একজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে।
আইনজীবীদের ঘনিষ্ঠজনরা বলেছেন, তারা আদালতে যেমন যাচ্ছেন না, তেমনি নিজস্ব চেম্বারেও বসছেন না। কাউকে সাক্ষাৎও দেন না। ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গেও তাদের এখন যোগাযোগ নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের কাছে থাকা মামলাগুলোর পরিণতি কী হবে— এ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলেছেন, আইনজীবীদের আত্মগোপনে বা অন্তরালে থাকার মতো এমন অস্বাভাবিক ঘটনা আগে ঘটেনি। তাদের মতে, গত কয়েক বছরে মাঠের রাজনীতি আদালতে নিয়ে আসা, বাইরের রাজনীতিতে আইনজীবীদের অতিমাত্রায় অংশগ্রহণ ও বেপরোয়া মনোভাব এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি এএম আমিন উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার নামে হত্যা মামলা হয়েছে। গত ৭ আগস্ট তিনি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
সুপ্রিম কোর্টে তার ঘনিষ্ঠ একজন আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্যারের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে এক মাস আগে। তিনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন, জানা নেই। সুপ্রিম কোর্টে নিজস্ব চেম্বারেও আসেন না। তিনিও যোগাযোগ করেন না, আমরাও করি না।’
যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, কামরুল ইসলাম, শ ম রেজাউল করিম, মোখলেছুর রহমান বাদলসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের মোবাইল ফোন সচল থাকলেও তিনি সাড়া দেননি। অন্যদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের রেলমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নূরুল ইসলাম সুজন গত ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যার অভিযোগে মামলায় তিনি পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ডে আছেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী গ্রেপ্তার হন ১৫ সেপ্টেম্বর। হত্যা মামলায় তিনি কারাগারে আছেন। সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাছান চৌধুরী গত ১০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন ঝিনাইদহের সীমান্ত এলাকা থেকে। তিনিও হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি হবে তা শীর্ষ আইনজীবীদের ধারণায় ছিল না। এ পরিস্থিতিতে কখন কার নামে মামলা হয়, কে অসম্মানের শিকার হন, গ্রেপ্তার হন সেজন্যই তারা প্রকাশ্যে আসেন না।’
নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামীপন্থি একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যক্তিগত চেম্বারে বসি। সুপ্রিম কোর্টে মাঝেমধ্যে যাই। এখন ভ্যাকেশন চলছে। তাই যাওয়া হয় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, শান্তি ফিরে আসুক।’
একই পরিস্থিতি ঢাকার আদালতে
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই বছরের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হিসেবে নিয়োগ পান অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবু। ১৫ বছরের বেশি দায়িত্ব পালনের পর গত ২৭ আগস্ট তার নিয়োগ বাতিল করে আইন মন্ত্রণালয়। তবে এর আগেই তিনি চলে যান আত্মগোপনে। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুদিন আগে থেকে তিনি আদালতমুখো হননি।
আবদুল্লাহ আবুর মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তার ব্যাপারে ঘনিষ্ঠজনরাও কিছু বলতে পারেননি। তার ঘনিষ্ঠ অতিরিক্ত পিপি পদমর্যাদার একজন আইন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি কোথায় আছেন ধারণা নেই। তিনিও তার অবস্থান জানাননি। একই অবস্থা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরুর। সরকারের পতনের পর আর আদালত এলাকায় দেখা যায়নি তাকে। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকে গত আগস্টের শুরু থেকে আদালত এলাকায় দেখেননি বলে জানান আইনজীবীরা। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় বিশেষ কৌঁসুলি হিসেবে তার নিয়োগ গত ৫ সেপ্টেম্বর বাতিল করে আইন মন্ত্রণালয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকার আদালতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সাড়ে ৬০০ আইন কর্মকর্তার বেশিরভাগই আদালতে আসছেন না। এখন পর্যন্ত নতুন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরসহ অন্যান্য আইন কর্মকর্তার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। এতে করে ঢাকার আদালতে মামলার বিচারকাজ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফৌজদারি গুরুত্বপূর্ণ মামলাসহ বেশিরভাগ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শুনানি হচ্ছে না। দেওয়ানি মামলাগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা।
ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান মানিক, অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মামুন, অ্যাডভোকেট আবদুল বাতেন, অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান হাওলাদারসহ আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে আদালতে আসছেন না বলে জানা গেছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অতীতে মার্শাল ল বা এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক আইনজীবী অন্তরালে থাকলেও এমন পরিস্থিতি কখনো ছিল না যে, অসংখ্য আইনজীবীকে এভাবে আত্মগোপনে থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা ক্ষমতার জোর আইনজীবীদের ওপর খাটিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বার, ঢাকা বারের ভোটের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। অন্য মতাদর্শের আইনজীবীরাও এজন্য দায়ী ছিলেন। বাড়াবাড়ির পরিণতি তারা এখন ভোগ করছেন। আইনজীবীদের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালতে না আসা এবং কাউকে আসতে না দেওয়া একটা অপসংস্কৃতি। এটা দুঃখজনক। তবে সুপ্রিম কোর্টে অনেক আইনজীবী (আওয়ামীপন্থি) আসতে শুরু করেছেন। যারা আসছেন না তারা যদি সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, কেন আসছেন না, তাহলে আমরা বিষয়টি দেখব।’
সম্মানহানি বা গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন কি না— এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা তাদের ব্যক্তিগত স্ট্র্যাটেজি। আদালত বা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস কাউকে নিরুৎসাহিত করেনি, প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করেনি।’