Trending

দালালের খপ্পরে পড়ে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে: রাশিয়ায় পাচার হওয়া ভুক্তভোগীদের করুণ বর্ণনা

ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ায় নেওয়া হয় এবং সেখানে পৌঁছানোর পরপরই সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসজুড়ে তারা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। তাদের মধ্যে একজন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে এবং আরও দুজন এখনো নিখোঁজ।

রুশ সেনার সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করছিলেন আরমান মণ্ডল। ভারী বর্মে আবৃত আরমানের যুদ্ধের ময়দানের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তার কাঁধে ঝুলছিল ১২ কেজির বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, একটি ভারী রাইফেল এবং গুলি ও বিস্ফোরকে ভরা ২০ কেজির ব্যাকপ্যাক। 

যুদ্ধক্ষেত্রের গভীরে প্রবেশ করতেই শুরু হয় ড্রোন হামলা। হামলা এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎই মোটরসাইকেলটি ল্যান্ডমাইনে আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণে মারা যান তার রুশ সহযাত্রী। প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়েন আরমান—তার পা গুরুতরভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। তবে তিনি কোনোভাবে বেঁচে যান।

নিজেকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারেন, ল্যান্ডমাইন তার প্রাণ কেড়ে না নিলেও আকাশ থেকে হওয়া ড্রোন হামলা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও সীমাহীন কষ্টে আবার মোটরসাইকেলটি চালিয়ে তিনি কোনোভাবে যুদ্ধের ময়দান পেরিয়ে একটি রুশ সেনা ক্যাম্পে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছানোর পরপরই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। রুশ সেনারা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়।

সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে, আরমান মণ্ডলকে দুই দিনের দীর্ঘ ভ্রমণের পর নেওয়া হয় নভোরোসিস্কের একটি হাসপাতালে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি, পায়ে প্লাস্টার করা। হোয়াটসঅ্যাপে লাইভ লোকেশন শেয়ার করে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন আমাদের।

রাশিয়ার ওই হাসপাতাল থেকে আরমান বলেন, ‘বাংলাদেশে দালালরা বলেছিল, রাশিয়ায় কোনো সাধারণ কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু এখানে এনে আমাদের যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমার পাসপোর্ট রুশ এক কমান্ডারের কাছে, আমি জানি না কবে বা কীভাবে দেশে ফিরতে পারব’। 

আরমান একা নন—তার মতো অন্তত সাত বাংলাদেশি একই পরিস্থিতির শিকার। তাদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ আমিনুল, আকরাম হোসেন, সোহান মিয়া, মোবারক হোসেন সাদ্দাম, রহমত আলী ও হুমায়ুন কবির। তাদের সবাইকে-ই কাজ দেয়ার কথা বলে রাশিয়ায় পাচার করা হয়েছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়তে জোর করে যুক্ত করা হয়েছে রুশ সেনাবাহিনীতে। 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের রাশিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল ‘ড্রিম হোম ট্রাভেল’ নামের একটি এজেন্সি। এই এজেন্সির মালিক আওয়ামী লীগের এক নেতা আবুল হাসান ও তার সহযোগী তামান্না জেরিন।

দালালচক্র ভুক্তভোগীদের পর্যটক ভিসায় রাশিয়ায় সাধারণ চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাঠিয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য তামান্নার ভাই নাজমুল হাসান তুহিনকেও তাদের সঙ্গে পাঠানো হয়। কিন্তু পরে তাদের রুশ এজেন্টের কাছে ‘বিক্রি’ করে দেওয়া হয়, যারা তাদের পরে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করে।

এই পাচারচক্রের অন্যতম মূল হোতা তামান্না জেরিন ৬ ফেব্রুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নেপাল পালানোর সময় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাকে গ্রেপ্তার করে।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাকি অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা কেউ সাড়া দেননি।

রাশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি সম্পর্কে অবগত রয়েছে।

মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ শাখার ফার্স্ট সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান সরকার বলেন, ‘আমরা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছি, যাতে তাদের সেনাবাহিনী থেকে ছাড়িয়ে আনা যায়’। 

ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ায় নেওয়া হয় এবং সেখানে পৌঁছানোর পরপরই সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসজুড়ে তারা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। তাদের মধ্যে একজন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে এবং আরও দুজন এখনো নিখোঁজ।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে আকরাম হোসেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনোভাবে বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছেন।

আকরাম বলেন, ‘দালালরা আমাদের রাশিয়ার এজেন্টদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করেছে। আমাদের মৃত্যুর পর রুশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তারা বড় অঙ্কের অর্থ পেত। তামান্নার ভাই সম্ভবত তা নেয়ার জন্যই সেখানে গিয়েছিল’। 

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসার পরও আকরাম প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। তার দাবি, রাশিয়ার এজেন্টরা তাকে এখনো খুঁজছে। তবে তার ভাই সোহান মিয়া এখনো রুশ সেনাবাহিনীতে আটক রয়েছেন।

আকরাম জানান, সোহানকে যেকোনো দিনই ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। 

আকরাম ও আরমান দুজনেই টিবিএসকে জানান, যুদ্ধে যে বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন তার নাম হুমায়ুন কবির। 

আরমান বলেন, ‘তার ভগ্নিপতি রহমত আলী আমাদের বলেছিলেন যে, আহত হওয়ার পর হুমায়ুন কবির তার কোলে মারা যান’। 

তবে রহমত আলী নিজেও এখন নিখোঁজ। আকরাম ও আরমানের দাবি, রুশ সেনারা রহমতকে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে, তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

টিবিএস রহমতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হতে দূতাবাসের কর্মকর্তা মাজেদুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তিনি কোনো সাড়া দেননি। 

একইভাবে, কতজন বাংলাদেশিকে পাচার করে রুশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও সরকারের কোনো তথ্য আছে কি না, সে প্রশ্নেরও কোনো জবাব মেলেনি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকেও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে এনিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

আমিনুলের স্ত্রী ঝুমু আক্তার এখনো অনিশ্চয়তায় আছেন তার স্বামীর ভাগ্য নিয়ে। দুই সন্তানের জননী ঝুমু জানান, সাত দিন আগে তার স্বামীর সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল। তখন তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিন দিন যুদ্ধ করে ফিরে এসেছেন।

কিন্তু এবার তিনি যুদ্ধে যাওয়ার পর সাত দিন পার হলেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

‘আমি জানি না আমার স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না—কোথায় যাব, কী করব, কীভাবে সন্তানদের মানুষ করব,’ বলেন ঝুমু আক্তার।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d