Hot

দিনে লরি, রাতে জাহাজ থেকে তেল চুরি

সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর বড়াল নদীতে রাতের আঁধারে প্রতিদিন তেলবাহী জাহাজ থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার লিটার ডিজেল, অকটেন। বিশেষ কায়দায় পাইপলাইন থেকে ড্রামে তেল ভরার পর ছোট নৌকায় করে সেগুলো চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। এই চুরির সঙ্গে জড়িত একটি শক্তিশালী চক্র। এর মধ্যে রয়েছেন জাহাজের সারেং, তেল ডিপোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তেল চুরির কারণে বছরে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। সেই টাকায় ফুলেফেঁপে উঠছে অপরাধী চক্র। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় এই লুটপাট চললেও যেন দেখার কেউ নেই। সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদীর তীরে ১৯৮৩ সালে ৪৭ একর জায়গার ওপর নির্মিত হয় এ বন্দর। রয়েছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানির তেলের ডিপো। এখান থেকে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া নদীপথে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার জন্য সার, কয়লা, সিমেন্ট, চাল, গম, জ্বালানি তেলসহ ৯০ শতাংশ নিত্যপণ্য নামে এই বন্দরে। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকট দেখা দেওয়ায় পণ্য নিয়ে বড় জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারে না। সে সময় বাঘাবাড়ী থেকে প্রায় ৪৫ মাইল দূরে মানিকগঞ্জের বাহাদুরাবাদে যমুনা নদীতে জাহাজগুলোকে অবস্থান করতে হয়। সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে মালপত্র আসে।  

যেভাবে চুরি
বড়াল নদীর ওপরে ব্রিজ পার হয়েই রামখেরুয়া সড়ক। এ সড়ক ঘিরেই চলে নানা অপকর্ম। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে চরচিথুলিয়া গ্রাম। রাতে সেখানে রাজ্যের নীরবতা। আলো-আঁধারিতে তেলের জাহাজ ঘিরে দেখা যায় ছোট ছোট নৌকা। শ্রমিকরা দ্রুত কাজ করলেও তাদের মধ্যে তাড়াহুড়া নেই। তারা জাহাজের তেলভর্তি ট্যাঙ্কার থেকে পাইপে করে তেল সরিয়ে নিতে সহায়তা করছে। আর নৌকায় থাকা চক্রের সদস্যরা ভরা ড্রাম নৌকায় সাজানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। সেখানে কোনো পুলিশি টহল চোখে পড়েনি।

এক নৌকার মাঝি নাম প্রকাশ না করে বলেন, এই কাজ সব রাতেই হয়। আমরা জানলেও কাউকে বলার মতো সাহস করি না। যারা এসব কাজে জড়িত তারা প্রভাবশালী। টের পেলে জানে মেরে ফেলবে। আর থানা পুলিশের সঙ্গে তাদের রসায়ন দহরম-মহরম। চক্রের সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরাও আছে। বিষয়টি পুরো এলাকা জানে। তারা চোরাই তেল প্রতিদিন কালোবাজারে বিক্রি করে। 
চক্রে যারা 

বাঘাবাড়ী ঘাটে জাহাজ থেকে তেল চুরি চক্রের প্রধান ল্যাংড়া স্বপন। তাঁর সঙ্গী শাকতোলা গ্রামের ফারুক হোসেন, ওমর হাজী ও বড়বায়রা গ্রামের মোতালেব হোসেন। আগে তারা সবাই  ঘাটকেন্দ্রিক কুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন সব ছেড়ে তেল চুরি সামলান। বাঘাবাড়ী ঘাটের আশপাশের ১০ গ্রামের আরও ৪০ জন এই চক্রের সদস্য। এদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছেন নুকালি গ্রামের সম্রাট শাহজাহান ও মন্টু মিয়া, আলোকদিয়ার জহুরুল সরকার, আব্দুল কাদের, রফিকুল ইসলাম, আলম মিয়া, শামীম হোসেন এবং শাকতোলার সাদেক হোসেন। রাতে এরাই জাহাজ থেকে তেল নামানোর মূল দায়িত্বে থাকেন। আর চক্রের অন্য সদস্যরা আশপাশের এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আলোর সংকেত দিয়ে টহল দেয়। তবে স্থানীয় থানা পুলিশ ও পোর্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ থাকায় কখনও কেউই তাদের কাজে বাধা দেয় না। এ ব্যাপারে ল্যাংড়া স্বপনের মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

চোরাই তেলের বেচাকেনা 
বাঘাবাড়ী ডিপোতে আসা জাহাজ থেকে চুরি হওয়া তেল ছড়িয়ে দেওয়া হয় কালোবাজারে। কাজটি করা হয় কয়েকটি ধাপে। চুরির পর নদীপথে তেল অন্যত্র পাঠানোর পাশাপাশি স্থানীয় চক্রের পরিচালিত গুদাম ও ডিপোতে মজুত করা হয়। এসব গুদামে মজুত রাখা যায় হাজার হাজার লিটার তেল। পরে সেই তেল বিক্রি করা হয় পাইকারি দামে। বোরো মৌসুমে ডিজেলের চাহিদা বেশি থাকায় এ সময় তেল বেশি চুরি হয়। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতি লিটারে ১০ থেকে ১৫% কম দামে বিক্রি করা হয় চোরাই তেল। ভেজাল থাকলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম ২০ শতাংশেরও কম রাখা হয়। এই তেল সাধারণত কৃষি এবং পরিবহন খাতে বেশি ব্যবহৃত হয়।

চক্রের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন জাহাজ ও ট্যাঙ্কার থেকে ৫০ থেকে ৭০ হাজার লিটার তেল চুরি হয়। মাসে পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ থেকে ২০ লাখ লিটার। আর বছরে দুই থেকে আড়াই কোটি লিটার। লিটারপ্রতি ২ টাকা করে লাভ হলেও চোরাই এই তেলের আনুমানিক বাজারদর প্রতিদিন ২ কোটি টাকা। মাসে ৬০ কোটি আর বছরে টাকার অঙ্কে মূল্য দাঁড়ায় ৭০০ কোটির ওপরে।

বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে উত্তরের ১৬ জেলায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৬ লাখ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। তবে নাব্য সংকট থাকলে জাহাজগুলো পূর্ণ ধারণক্ষমতায় তেল পরিবহন করতে পারে না। ফলে প্রতিদিন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লিটার তেল ডিপোতে পৌঁছায়।

ঘাটতি তেলের নয়ছয় হিসাব
বেশির ভাগ জাহাজে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তেল চোরাই চক্রের কাছে বিক্রি হয়। এই তেলের ঘাটতি পূরণে নেওয়া হয় অভিনব পন্থা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাঘাবাড়ী ডিপোর এক কর্মচারী জানান, চুরি হওয়া তেলের হিসাব গোপন রাখতে জাহাজের সারেং ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একাধিক কৌশল নেন। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ক্ষতির মুখোমুখি হয়। এই চক্রের সঙ্গে ডিপোর অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তারাও নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন পেয়ে থাকেন।

ঘাটতি পূরণে কৌশল হিসেবে কাগজে বেশি, বাস্তবে কম তেল বুঝে নেওয়া হয়। প্রতি জাহাজে যে পরিমাণ তেল আনা হয়, তার হিসাব একটি নথিতে উল্লেখ থাকে। তবে এই নথিতে ইচ্ছা করে তেলের পরিমাণ কমিয়ে নেন তারা। ফলে তেল চুরি হলেও কাগজপত্রে সব ঠিকঠাক দেখানো যায়। এ ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে তেলের পরিমাণ মাপার জন্য নির্দিষ্ট গেজ বা মিটার ব্যবহার করা হয়। সারেং ও ক্রুরা আগেই গেজের রিডিং কারসাজি করে রাখেন। যাতে ডিপোতে পৌঁছানোর সময় হিসাব ঠিক থাকে। এতে কাগজে দেখানো পরিমাণ ও বাস্তব তেলের পরিমাণের ফারাক ধরা পড়ে না। আবার কখনও কখনও তেল চুরির ঘাটতি মেটানোর জন্য ট্যাঙ্কারের নিচের অংশে পানি মিশিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তেলের পরিমাণ বেশি দেখানো যায়।

নিয়ম অনুযায়ী জাহাজ থেকে খালাসের পর ডিপোর কর্মকর্তাদের তেল পরিমাপ করার কথা। তবে অনেক সময় তারা ইচ্ছা করে ভুল তথ্য লেখেন বা গেজের রিডিং সঠিকভাবে পরীক্ষা করেন না। কিছু অসাধু কর্মকর্তা চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে চুরি হওয়া তেলের হিসাব গোপন রাখতে সাহায্য করেন।

দিনে ট্যাঙ্কলরি থেকে তেল চুরি
নদীতে জাহাজ ছাড়াও বাঘাবাড়ী ডিপোর আশপাশে ট্যাঙ্কার থেকে তেল চুরির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার পথে ট্যাঙ্কলরির চালক-সহকারীরা দিনে ও রাতে সবসময়ই ট্যাঙ্কার থেকে তেল নামিয়ে বিক্রি করেন। সেখানে গড়ে ওঠা অবৈধ চোরাই তেলের দোকান মালিকরা এর ক্রেতা। আশপাশে এ ধরনের দোকান ডিপো রয়েছে পাঁচ শতাধিক। তেলের দোকান ছাড়াও বাঘাবাড়ী ডিপো থেকে সিরাজগঞ্জ রোড পর্যন্ত ১৪ স্থানে আসল তেল বদল করে ভেজাল তেল নেওয়ার মিনি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় আছে প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৭০০ লিটার পর্যন্ত তেল বদলের সুযোগ। তেল ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের বলেন, ডিপো থেকে প্রতিদিন ৬৫০ থেকে ৭০০ ট্যাঙ্কলরি জ্বালানি তেল বহন করে। এর মধ্যে শুধু ডিজেল বহনকারী ট্যাঙ্কলরির সংখ্যা চার শতাধিক। বাকিগুলো পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিন বহন করে। অধিকাংশ ট্যাঙ্কলরি থেকে চালক ও সহকারীরা ২২০ থেকে ৪৪০ লিটার পর্যন্ত তেল চুরি করে পথেই বেচে দেয়।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
শাহজাদপুর থানার ওসি আসলাম আলী চোরাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযানের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। সেখানে তেল চুরির কোনো অভিযোগ তাঁর কাছে নেই বলে জানান। চোরাকারবারির সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কের বিষয়টি নাকোচ করে তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রস্তুত।

এ ব্যাপারে বাঘাবাড়ী তেলের ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম সাদেকীনের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল। এসএমএস করলেও তিনি সাড়া দেননি।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। উপজেলা প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের। তারা অভিযান চালালে উপজেলা প্রশাসন সহযোগিতা করে। তবে এক বছরে এ ধরনের কোনো অভিযান হয়নি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor