‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে, ভেস্তে গেছে মন্ত্রী এমপির সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ
‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের (এমপি) সম্পদের হিসাব প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যে দুর্নীতি নির্মূলের এই অঙ্গীকার থেকে সরে আসতে দেখা যায়। কারণ, তখন বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভেতর অস্বস্তি দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা পরে বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের আয়কর বিবরণীতে দেওয়া সম্পদের হিসাবই যথেষ্ট। উদ্যোগটি এখন পর্যন্ত আর বাস্তবায়ন হয়নি।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এনে মহাজোটকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানায়। তাতে ব্যাপক সাড়াও মেলে। নির্বাচনী ইশতেহারে যে পাঁচটি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তাতে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক ৫.৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’
এর পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার ইস্যুতে বেশ সোচ্চার দেখা যায়। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এতে দেশের মানুষ বুঝতে পারবে, মন্ত্রী বা এমপি হওয়ার আগে কত সম্পদ ছিল; দায়িত্ব নেওয়ার পর কত সম্পদ হয়েছে।’
তবে ওই সরকারের মেয়াদ এক বছর পেরিয়ে গেলেও মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার কাজে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এ অবস্থায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আগামী জুনের আগেই মন্ত্রী-এমপি, বিচারপতি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশ করা হবে।’ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারের প্রথম বছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
কিন্তু এর তিন মাসের মাথায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের আয়কর বিবরণীতে দেওয়া সম্পদের হিসাবই যথেষ্ট। নতুন করে আর হিসাব দিতে হবে না। সরকারের এ সিদ্ধান্তে বিভিন্ন মহল থেকে তখন সমালোচনা হয়। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থাও সমালোচনা করে।
এমন পরিস্থিতিতে ২০১১ সালের ৪ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী-উপদেষ্টারা তাদের সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন। তবে সরকারের বাকি সময়ে এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা, সেই তথ্য প্রকাশ হয়নি। তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা তখন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টারা তাদের সম্পদের হিসাব সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিচ্ছেন। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, অনেকেই সেটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন।’ ওই হিসাব প্রকাশ করা হবে কিনা, সে বিষয়ে অবশ্য তিনি কিছু বলতে পারেননি।
অন্যদিকে, এমপিদের সম্পদের হিসাব বিষয়ে সংসদ সচিবালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত আয়কর ফাইল সংসদ সচিবালয়ে আছে। সম্পদের হিসাব-সংক্রান্ত আর কোনো ফাইল জমা হয়নি।’ অবশ্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর সম্পদের হিসাব জমা দেন। অনেক বিচারপতিও তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেন প্রধান বিচারপতির কাছে।
এর পর আর মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ সামনে আসেনি। এমনকি ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করেনি। তবে তিন মেয়াদ শেষ করে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগের শেষের তিনটি নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার হলো, ‘দুর্নীতি নির্মূল ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’।
অনেকে মনে করেন, নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল ওই সময়কার সরকার। তবে সিংহভাগ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্যের মধ্যে এ নিয়ে অনীহা ছিল, কারও কারও মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছিল। সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বলায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মুহিত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সহকর্মীদের তোপের মুখেও পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত ওই উদ্যোগ থেকে সরে আসে সরকার।
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা সরকারের কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘সম্পদের হিসাব প্রকাশের উদ্যোগ থেকে সরে এলেও আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি নির্মূল ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে সরে আসেনি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের দুটি জায়গায় সম্পদের হিসাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এক জায়গায় মন্ত্রী-এমপি, আরেক জায়গায় ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু ওই প্রতিশ্রুতি তারা পুরোপুরি ভঙ্গ করেছে। শুধু তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভ্রূক্ষেপ করেননি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’
তিনি বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন কমিশনে হলফনামার মাধ্যমে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান চালু হয়েছে। এটা কিন্তু দেশের সুশীল সমাজের উদ্যোগ ও আদালতের নির্দেশে হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এটি চালু হওয়ার প্রক্রিয়াকেও ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা হয়েছিল।’