Hot

দুঃখ ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ

দেশবাসীকে লজ্জায় ভাসিয়ে না ফেরার দেশে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়া। পুরো দেশের মানুষের প্রার্থনা আর ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে ছোট্ট আছিয়া হার মেনেছে ভয়ানক পাশবিকতার কাছে। গতকাল বেলা ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মাগুরায় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার আছিয়ার ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম পাশবিক ঘটনার প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে শহর থেকে গ্রামে। রাজপথ উত্তপ্ত হয়েছে মিছিল আর স্লোগানে। একই সঙ্গে তার ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা ছিল প্রতিটি মানুষের। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সিএমএইচ থেকে আসা দুঃসংবাদে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। শোক আর ক্ষোভে একাকার মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে মানুষরূপী কুলাঙ্গারদের। সব শ্রেণি- পেশার মানুষ দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন। ওদিকে গতকালই মাগুরার গ্রামের বাড়িতে নামাজে জানাজার পর আছিয়ার দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। ওদিকে আছিয়ার ওপর চালানো পাশবিকতার ঘটনার দ্রুত বিচার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় ছাত্র-জনতা। 

সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছিয়াকে গতকাল বেলা ১টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। হাপাতালটির পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের প্রফেসর কর্নেল নাজমুল হামিদ এই তথ্য নিশ্চিত করেন। এদিনও সকালবেলা দুই দফায় শিশুটির ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়। সিপিআর দেয়ার পর তার হৃৎস্পন্দন ফিরে এসেছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় তার আবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এই দফায় সিপিআর দেয়ার পরও তার হৃৎস্পন্দন ফেরেনি। বেলা ১টায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আগের দিনও আছিয়ার চারবার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়। আছিয়ার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সিএমএইচে। শোকে বিহ্বল তার মা দাবি করেছেন, কন্যা হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের ফাঁসি। আছিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন সরকারপ্রধান। আছিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে পরিবারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে সেনাবাহিনী। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার আগামী সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে। শিশুটির মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন আইজিপি বাহারুল আলম। 
আছিয়ার মৃত্যুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন তিনি। 

জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান পৃথক বিবৃতিতে আছিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। 

এদিকে এই মৃত্যুর ঘটনায় গতকালও প্রতিবাদমুখর ছিল দেশ। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় শিশুর প্রতি নিপীড়নের প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়েছে। ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের উদ্যোগে আছিয়ার গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাহবাগে গায়েবানা জানাজা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে। শোক প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। দুপুরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে, মাগুরায় নির্যাতনের শিকার শিশুটি বেলা ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সিএমএইচের সর্বাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। দু’বার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃৎস্পন্দন ফিরে আসেনি। এতে আরও বলা হয়, ৮ই মার্চ শিশুটিকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে। যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে সেনাবাহিনী।

এর আগে ৫ই মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রাতে ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার হয় আট বছরের শিশুটি। বোনের শ্বশুর তাকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায় শিশুটি। ধর্ষণের ঘটনায় সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার বোনের অভিযোগ, গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও তাকে চিকিৎসার জন্য না নিয়ে উল্টো ঘরের ভেতরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। পরদিন ৬ই মার্চ সকালে প্রতিবেশী এক নারী তাদের ঘরে এলে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যায়। এরপর শিশুটিকে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। ততক্ষণে শিশুটি অচেতন হয়ে পড়ে। হাসপাতালে গিয়ে বোনের শাশুড়ি চিকিৎসকদের জানান শিশুটিকে জ্বিনে ধরেছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিষয়টি টের পেয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় বোনের শাশুড়ি। ৬ই মার্চ দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ওইদিন রাতেই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুইদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ৮ই মার্চ শনিবার তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে সিএমএইচে চিকিৎসা নিচ্ছিল শিশুটি। সিএমএইচ সার্জারি বিভাগের প্রধানকে প্রধান করে আছিয়ার জন্য ৮ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে। কিন্তু দিন দিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সোমবার চোখের পাতা নাড়ে শিশুটি। 

চিকিৎসকরা যখন তাকে বাঁচানোর আশা করছিল তখন ফের অবনতি হতে থাকে তার শারীরিক অবস্থা। এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় মাগুরা সদর থানায় মামলা করেছেন শিশুটির মা। এতে শিশুটির বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাশুর ও ভগ্নিপতিকে আসামি করা হয়েছে। তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হবে। আইন উপদেষ্টা গতকাল বলেন, আছিয়া দুপুর ১টার দিকে সিএমএইচে মারা গেছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা শোক জানিয়েছেন। আমরা সবাই শোকার্ত, এর মধ্যে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা পোস্টমর্টেম প্রতিবেদন নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আছিয়ার মরদেহ দাফনের জন্য মাগুরায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে হেলিকপ্টার যোগে। আছিয়ার মরদেহ এবং তার পরিবারের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার উপস্থিত থাকবেন। তিনি সেখানে দাফন পর্যন্ত থাকবেন। ‘ডিএনএ স্যাম্পল কালেকশন করা হয়ে গেছে, আশা করি আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাবো। এরই মধ্যে ১২-১৩ জনের ১৬১ ধারায় স্টেটমেন্ট নেয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী সাত দিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু হবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা যদি সাতদিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু করতে পারি, আমাদের বিচারকরা সর্বোচ্চ দ্রুততার সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার করতে পারবেন। কারণ এখানে পারিপার্শ্বিক এত সাক্ষ্য রয়েছে, ডিএনএ টেস্ট পাওয়া যাবে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে- ফলে আমরা আশা করছি খুব দ্রুত সময়ে এই মামলার বিচার হবে। ইনশাআল্লাহ দোষী সাব্যস্ত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। এদিকে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে ‘নরপশুদের’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক শোক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিল। ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে শিশুটি জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের কতোটা লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

জানাজায় মানুষের ঢল 
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, গতকাল আছিয়ার মরদেহ ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে বিকাল সাড়ে ৫টার পর মাগুরা স্টেডিয়ামে পৌঁছায়। শহরের নোমানী ময়দানে সন্ধ্যা ৭টায় শিশু আছিয়ার জানাজায় অংশ নেন হাজার হাজার মাগুরাবাসী। জানাজা পরিচালনা করেন মাগুরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতি হাবিবুর রহমান। জানাজা শেষে আছিয়ার লাশ দাফনের জন্য তার নিজ বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের জারিয়া গ্রামে নেয়া হয়।

এ সময় বিচার চেয়ে শহরে বিক্ষোভ করে ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভ মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ভায়না এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে। 

শিশু আছিয়ার মৃত্যুর খবর নিজ বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের জারিয়া গ্রামে পৌঁছালে সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়ে তার স্বজনরা। বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসে আছিয়াদের বাড়িতে। পুরো এলাকা হয়ে পড়ে শোকাচ্ছন্ন। 

স্থানীয় বাসিন্দা হামিদুর রহমান বলেন, আজ আছিয়া আমাদের মাঝ থেকে চলে গেল। তাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। আমরা চাই ধর্ষকের ফাঁসি। আজ একজন মা হারালো তার সন্তানকে। সন্তান হারানোর বেদনা খুবই কষ্টের। আমরা শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে আছি। 

এলাকার প্রতিবেশী কৃষ্ণ বালা বলেন, আছিয়ার মৃত্যুর খবরে আমি খুবই ব্যথিত হয়েছি। আমি ২ সন্তানের জননী। যে শিশু আজ মারা গেল সে আমাদেরই সন্তান। আমরা আমাদের সন্তানকে যারা পৃথিবী ছাড়া করলো তাদের সবার বিচাই চাই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button