Bangladesh

দুটি নতুন খনি উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই: গচ্চা ১২০ কোটি টাকা!

জরিপ শেষ হওয়ার ছয় বছর পরও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট দুটি নতুন খনির উন্নয়নকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। অথচ দুই খনির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে এরই মধ্যে ১২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, খনি দুটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে যে জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। একটি নামসর্বস্ব ও কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে দিয়ে দুটি খনির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জরিপকাজ চালানো হয়। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম দফায় ২০১৭ সালে কয়লা খনির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল, সেটি আন্তর্জাতিক মানের তৃতীয় একটি কোম্পানিকে দিয়ে মূল্যায়ন (রিভিউ) করা হয়। মূল্যায়ন রিপোর্টে দেখা যায়, তৈরি করা রিপোর্টটি ছিল ভুলে ভরা, কপি-পেস্ট ও দায়সারা গোছের। এরপর ওই রিপোর্টটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। কিন্তু সবকিছু জেনে-শুনেও একই মানের কোম্পানিকে ফের পাথর খনির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পরেরবারও কোম্পানিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা আগের চেয়েও খারাপ। বাধ্য হয়ে এবার তৃতীয় কোনো কোম্পানিকে দিয়ে মূল্যায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, এ দফায়ও রিপোর্টটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় পুরো ১২০ কোটি টাকাই পানিতে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জরিপের যে ফলাফল, তা দিয়ে খনি উন্নয়নের কার্যাদেশ দেওয়া সম্ভব নয়। এর আগেও এই কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পেট্রোবাংলার ৯১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। পরে তদন্তে ধরা পড়লে ওই প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। কালো তালিকাভুক্ত করা হয় কোম্পানিটিকে। কিন্তু এতকিছুর পরও বারবার একই কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা যায়, জসিম উদ্দিন মজুমদার নামে চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার কোম্পানি বলে কথা। জ্বালানি সেক্টরে তার বিরুদ্ধে কথা বলারও সাহস নেই কারও। তার বিরুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা টুঁ শব্দ করলে তাকে চাকরি হারাতে হয়।

যদিও জসিম উদ্দিন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি রাজনৈতিক চাপ দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যাদেশ নেননি। জ্বালানি সেক্টরে তার কোম্পানির অনেক অবদান আছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানিকে দিয়ে দুটি খনির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রিপোর্ট তৈরি করেছেন। তার রিপোর্ট সঠিক আছে। 
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, খনি দুটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় মূলত আটকে গেছে এই ফাইল। এতে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।

মধ্যপাড়া পাথর খনিসংলগ্ন দীঘিপাড়া এলাকায় একটি নতুন পাথর খনি উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডি) কাজ দেওয়া হয়েছিল জার্মানির দুই কোম্পানি মিবরাগ কনসালটিং ইন্টারন্যানাল জিএমবিএইচ ও ফুগরো জার্মানি ল্যান্ড জিএমবিএইচ এবং অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি আরপিএম গ্লোবালকে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

কারণ হিসাবে দেখা যায়, কোম্পানিগুলোতে এই সেক্টরের কোনো বিশেষজ্ঞ ও প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট নেই। তাদের মূলত ভাড়া করা লোক ও ইকুইপমেন্ট নিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। যদিও কার্যাদেশ পাওয়ার আগে তারা জানিয়েছিল তাদের সব ধরনের প্রযুক্তি ও এক্সপার্ট রয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটেও এ ধরনের তথ্য ছিল।

এর আগেও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিসংলগ্ন একটি নতুন কয়লা খনি উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দেওয়া হয়েছিল মজুমদার এন্টারপ্রাইজ নামের কোম্পানিকে। রিপোর্টটি যাচাই-বাছাইয়ের (রিভিউ) জন্য তখন একটি বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, ফিজিবিলিটি স্টাডির নামে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, সেখানে অধিকাংশ তথ্যই ভুয়া ও মনগড়া। 

এ অবস্থায় জ্বালানি খাতের দুটি বড় প্রকল্প অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রকল্প দুটি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশব্যাপী কয়লা ও পাথরের বিপুল চাহিদা থাকার পরও প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার এই সম্পদ আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে রিজার্ভের ওপর বড় চাপ তৈরি হচ্ছে। তাদের মতে, নতুন দুটি খনি উন্নয়নের কাজ শুরু হলে বিদেশ থেকে কয়লা ও পাথর আমদানি অনেকাংশে কমে যেত।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এর আগেও এই মজুমদার এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ভুয়া ও প্যাডসর্বস্ব কোম্পানি খুলে একটি বড় প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তখন তদন্তে দেখা গিয়েছিল বিদেশি যে কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করেছিল, ওই কোম্পানির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না। বাধ্য হয়ে তাদের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। তবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এবার মূলত দীঘিপাড়া ও বড়পুকুরিয়ার নতুন খনি উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে মজুমদার এন্টারপ্রাইজের কোনো ভূমিকা নেই। এখানে তারা লোকাল এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে। 

মূলত ফিজিবিলিটি স্টাডি দুটির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানিকে। এরপরও বিদেশি কোম্পানি নিয়ে কোনো অভিযোগ উঠলে আগের মতো তদন্ত করা হবে। তাতে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী জানান, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রিপোর্ট দুটি তিনি দেখেননি। প্রয়োজন হলে তিনি রিপোর্ট দুটি ফের রিভিউ করার নির্দেশনা দেবেন।

পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে এ দুটি জরিপের রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া পাথর খনিসংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তদন্ত হলে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসবে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ফিজিবিলিটি স্টাডি হলো একটি প্রকল্প লাভজনক হবে কি না, সরকারের কাছে এর সঠিক চিত্র তুলে ধরা। পাশাপাশি প্রকল্পের জিওলজিক্যাল অবস্থা, গ্রাউন্ড ওয়াটারের পরিমাণ এবং খনিতে কী পরিমাণ কয়লা ও পাথর মজুত আছে তা নির্ণয় করা। পরবর্তীকালে সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে মাইনিং মেথড অর্থাৎ খনিটি কোন পদ্ধতিতে খনন করা হবে তা নির্ধারণ করা। এছাড়াও প্রকল্পের আর্থসামাজিক অবস্থা নির্ধারণ অন্যতম কাজের অংশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মধ্যপাড়া পাথর খনি কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জন্টিভয়েড নামের যে কোম্পানির মাধ্যমে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা হয়েছে, বাস্তবে ওই কোম্পানিতে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো কোনো বিশেষজ্ঞ ও ইকুইপমেন্ট নেই। যে কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে এক্সপার্ট ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করে এনে তাদের জরিপ চালাতে হয়। তাদের এ দুটি জরিপ চালাতে গিয়েও বেশ কয়েকজন বিদেশিকে ভাড়া করে আনতে হয়েছে। কিন্তু তারা আদৌ এই সেক্টরের বিশেষজ্ঞ ছিলেন কি না, তা জানা যায়নি। জরিপ চলাকালীন সেরকম কোনো বিশেষজ্ঞকেও দেখা যায়নি। মোট কথা, দুটি খনির এই কাজে ১২০ কোটি টাকার পুরোটাই গচ্চা গেছে। 

মধ্যপাড়া গ্রানাইড মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) অপর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তারা যে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট পেয়েছে তা দিয়ে খনি উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে নতুন এই খনি রোমেন পিলার মেথডে খনন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এই মেথডে খনি উন্নয়ন করা অসম্ভব। এতে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়বে, অপরদিকে উৎপাদনও কম হবে। তাতে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে না। খনিতে পাথরের রিজার্ভ নিয়েও যে তথ্য দিয়েছে সেটি সত্য নয়। প্রকল্প এলাকায় অনেক ঘনবসতি, প্রচুর পরিমাণ বন ও গাছাপালা এবং ফসলের খেত আছে-এসব নিয়ে কিছু বলা হয়নি রিপোর্টে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে আছে মজুমদার এন্টারপ্রাইজ। এর আগে বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) তিতাস লোকেশনে ৭টি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপন প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করায় তাদের এই তালিকাভুক্ত করা হয়।

আরও অভিযোগ, মজুমদার এন্টারপ্রাইজ এর আগে টেকনোস্টিম এনার্জি নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করে বিজিএফসিএলে ৯১০ কোটি টাকার কাজ পায়। সেসময় যাচাই-বাছাই না করেই তড়িঘড়ি করে বিজিএফসিএল টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোয়া (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যু করে। পরে দেখা যায়, ওই কোম্পানিটি ভুয়া। ফলে নোয়া ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যেও কোম্পানিটি চুক্তি করতে পারেনি। জমা দিতে পারেনি দরপত্রের ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) টাকাও। কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজের প্রতারণার কারণে দরপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া সাড়ে ১২ কোটি টাকার বিডবন্ডটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়।

সেসময়ের তদন্তে দেখা যায়, টেকনোস্টিম এনার্জির কোনো অস্তিত্ব ছিল না যুক্তরাষ্ট্রে। কোম্পানিটির লেটারহেড প্যাডে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানেও এর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য তারা যেসব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছে, বাস্তবে কোম্পানিটি সেরকম কোনো কাজই করেনি। যদিও ওয়েবসাইটে সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা ছিল।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto