Bangladesh

দুর্গন্ধযুক্ত আয়নাঘরে পারফিউমের ঘ্রাণ! গুম-খুনের কালো অধ্যায়

৩২ বছর বয়সি যুবক হৃদয় (ছদ্মনাম)। ২০১৬ সালে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। ঠাঁই হয় আয়নাঘরে। কোনোরকম দণ্ডাদেশ ছাড়াই আট বছর কাটিয়েছেন সেই বন্দিজীবন। গুম কমিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হৃদয় জানিয়েছেন, সূর্যের আলো পৌঁছাত না সেই বদ্ধ কুঠুরিতে। চারদিকে শুধু মল-মূত্রের গন্ধ। সেই দুর্গন্ধ ছাপিয়ে মাঝে-মধ্যে ভেসে আসত পারফিউমের ঘ্রাণ। তখনই আশপাশে বেজে উঠত মোবাইলের রিংটোন। শোনা যেত একের পর এক মেসেজ নোটিফিকেশনের শব্দ। এরপরই আসত অনেকজনের পায়ের আওয়াজ। সেই সঙ্গে শোনা যেত হিন্দি ও ইংরেজিতে কথোপকথন। গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, গত ১৫ বছরে গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। যৌথ সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই, বন্দিবিনিময় চুক্তিসহ নানা আইনি কাঠামোর মধ্যে দিয়ে গুমের ঘটনাগুলোয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল অন্যান্য দেশ। গোপন বন্দিশালায় এমন ব্যক্তিরাও যেতেন যারা হিন্দিসহ অন্যান্য বিদেশি ভাষায় কথা বলতেন। এমনকি ভুক্তভোগীরা সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তারা অডিও রেকর্ডার বন্ধ করার অনুরোধ করতেন এবং ফিসফিসিয়ে কথা বলতেন। এক ভুক্তভোগী চলতি বছরের মাঝামাঝি গুম কমিশনে অভিযোগ দেন। বিলম্বে অভিযোগ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, গুম কমিশন নিজেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে জড়িত কি না সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। হৃদয় গুম কমিশনকে বলেন, ‘আমি হিন্দি ভাষা বলতে শুনেছি।… যখন পরিদর্শনে আসত, তখন আমাদের দেয়ালের দিকে মুখ করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বসিয়ে রাখত, সারা দিন নড়াচড়া করতে দিত না। আমি বুঝতে পারতাম যে অনেকজন লোক আসছে। পায়ের আওয়াজ শুনতাম। দুর্গন্ধের জায়গা- পেশাব, পায়খানার গন্ধ থাকত সব জায়গায়। হঠাৎ করে পারফিউমের ঘ্রাণ পেতাম। তার পর মোবাইলের রিংটোন, নোটিফিকেশনের আওয়াজ শুনতে পেতাম। যখন আসত, বুঝতে পারতাম পেছনে অনেকজন আমাকে দেখছেন।… তাদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনেছি।’ ২১ বছর বয়সি আরেক ভুক্তভোগী গুম হওয়ার পর এক বছর তিন মাস ২৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন। তাকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থানান্তর করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাকে বর্ডারে নিয়ে দুজন লোকের কাছে তুলে দেয়। তারা নদী ও কাঁটাতারের বেড়া পার করে ভারতে নিয়ে যায়। একটা বাসে তুলে দিয়ে বলে, এ বাস যেখানে থামবে, সেখানে নামবি। ওই জায়গায় লোক আসবে, তারা কাজ দেবে। আমি নামার পর দেখি, কেউই আসে না। রাস্তায় ছিলাম প্রায় চার দিন। খাবার-দাবার কিছু ছিল না। পরে এলাকার লোকজন আমাকে পুলিশে দেয়। থানায় আমাকে ‘আনপাসপোর্ট কেস’ দিয়ে জেলে পাঠায়। সেখানে দুটা টয়লেটের মাঝখানে নোংরা স্থানে ঘুমাতে দিত। কাজ করাত। খাবার কখনো দিত, কখনো দিত না। একদিন দিল্লি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লোক আসে। তারা ভারতবিরোধী, কাশ্মীরবিরোধী ভিডিও ছাড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।’

২০২১ সালে গুম হয়ে ১০ মাস নিখোঁজ ছিলেন ৩০ বছর বয়সি এক যুবক। তিনি বলেন, আটক অবস্থায় তার কাছে বারবার জঙ্গিসংশ্লিষ্টদের নাম জানতে চাওয়া হয়। এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘তুমি কয়টা নাম বলে চলে যাও।’ আমি বলছিলাম, ‘নাম জানি না… জঙ্গিসংশ্লিষ্ট… আমি নাম জানব কেমনে?’ পরে আমাকে ইন্ডিয়া চালান করে দেয়। যেদিন ইন্ডিয়া পাঠায় সেদিন গাড়িতে উঠিয়ে আমাকে জম টুপি পরায়। গাড়ি থেকে নামায় রাত ২টার দিকে। অনেক দূর রাস্তা হাঁটায়। পরে দুজন লোকের কাছে হস্তান্তর করে। তারা আমাকে নিয়ে থানায় দেয়। পরে জানতে পারি তারা পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা সংস্থা এসটিএফের লোক। সেখানে আনপাসপোর্ট মামলা দিয়েছিল। জেল খাটি। এখনো যদি কেউ কোনো সময় ক্লেইম করে যে, ‘এই লোকটাকে কেন বিনা দোষে শান্তি দিয়েছেন?’ তখন তারা বলতে পারে, ‘আমরা তো তাকে শাস্তি দিইনি। সে তো আসছে ইন্ডিয়া থেকে।’

গুম হওয়া অনেকে জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে বন্দিশালায় দেখা করতে সাদা চামড়ার ইংরেজি ভাষাভাষী লোকজনও আসত। ২১ বছর বয়সি এক যুবক ২০১৬ সালে গুম হয়ে দুই বছর ৮ মাস ৭ দিন নিখোঁজ ছিলেন। তিনি বলেন, ‘একদিন বন্দিশালায় এক কর্মকর্তা তাকে বলেন, ‘ফরেন গেস্ট আছে, ইংরেজিতে কথা বলবা।’ তখন আমি মনে করি ভারত থেকে কেউ আসছে। পরীক্ষা করার জন্য হিন্দিতে বলি। তখন বলল, ‘হিন্দিতে না, ইংলিশে বলতে হবে।’ দুই-তিন ঘণ্টা একই কথাবার্তা হয়। তার পর আমাকে বলে, ‘তুমি যদি কিছু বলতে না পার, তাহলে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। মানে… ইউ হ্যাভ টু লে গোল্ডেন এগ।’ পরের দিন আবার জিজ্ঞাসাবাদের কথা ছিল, তবে করেনি। গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কের পাশাপাশি, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই’-এর নামে পশ্চিমা সহযোগিতা থেকেও লাভবান হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ অংশীদারত্ব বাংলাদেশের নিরাপত্তা খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে, যদিও এ সময়ে নিপীড়নের মাত্রাও বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে যেহেতু পূর্বের শাসকগোষ্ঠী আর ক্ষমতায় নেই, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এসব নিরাপত্তা কাঠামো ও তার অন্তর্নিহিত চুক্তিগুলোর প্রকাশ্য পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto