Hot

দুর্নীতিতে ডুবছে বঙ্গবন্ধু সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল

  • ২৮৩ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার উপক্রম
  • দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হবে: ভিসি

চরম দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ৭৫০ বেডের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, এটি একটি করপোরেট হাসপাতাল হবে, যেখানে ব্রেন ক্যানসার, দুর্ঘটনায় বড় ইনজুরি, কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, ইউরোলজি, কার্ডিয়াক সার্জারি ও কার্ডিওলজিসহ সব ধরনের জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেবে দেশবিদেশি চিকিৎসক-নার্স। চিকিৎসাসেবার জন্য আর যেতে হবে না বিদেশ, যেমন বিদেশে করপোরেট হাসপাতালের সঙ্গে মার্কেট ও ফাইভ স্টার হোটেলও থাকে। আমেরিকা, সিংগাপুর ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এই ধরনের হাসপাতাল রয়েছে। সেই মডেলেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় বা স্বল্প সময়ে বিদেশি ডাক্তার-নার্সও থাকবেন। ‘দেশেই মিলবে বিশ্বমানের চিকিৎসা, যেতে হবে না বিদেশ’—এমন স্লোগানে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি। গত বছর লোকবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর থেকে থমকে আছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। উদ্বোধনের পর ২০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো হাসপাতালটি চালু করা হয়নি। অনেক কিছু করে দেখানোর আশা জাগানিয়া প্রতিষ্ঠানটি এখন যেন একটি মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল এই প্রতিষ্ঠান থেকে কার্যত কোনো সেবাই মিলছে না। ২৮৩ কোটি টাকার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খান বাদশা বলেন, এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে; শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু প্রায় এক বছর আগেই কাজ অসমাপ্ত রেখে ২০২২ সালে তড়িঘড়ি করে এটি উদ্বোধন করা হয়। এই হাসপাতালটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য চুক্তি অনুযায়ী ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় কোরিয়ান সরকার। বাকি ৫০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দেয়। চুক্তি অনুযায়ী এই হাসপাতালে দুই বছর চিকিৎসাসেবা ও প্রশাসন পরিচালনা করার কথা কোরিয়ান সরকারের ৫৬ জন স্পেশালিস্টের। কিন্তু কোরিয়ান সরকার বারবার চিঠি দেওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাতে সাড়া দেননি। এটা তাদের সঙ্গে একধরনের প্রতারণার শামিল। চুক্তির বাইরে গিয়ে ভিসির খেয়ালখুশিমতো হাসপাতাল পরিচালনা এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখানো চালু হতে পারেনি বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।  

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের নজিরবিহীন অপকর্মে হাসপাতালটি এখনো ‘শুরুর সংকটে’ই ঘুরপাক খাচ্ছে। ঐ সময় নিয়োগ, কেনাকাটা, পদোন্নতিসহ কিছুই হতো না ঘুষ ছাড়া। সিনিয়র, জুনিয়র ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বলেন, বিএসএমএমইউতে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নেই। সর্বাঙ্গে দুর্নীতির ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছেন অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। ফলে যে স্বপ্ন নিয়ে হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়েছিল, সেটি স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে, বাস্তবে আশানুরূপ কিছুই হচ্ছে না। তবে বিএসএমএমইউয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ঢেলে সাজাতে অর্গানোগ্রামও করা হচ্ছে। একজন সচিবের নেতৃত্বে অর্গানোগ্রাম তৈরির কাজ চলছে। পুরো বিষয়টি ভিসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ভিসি কাজ শুরু করেছেন। বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক ইত্তেফাককে বলেন, দেশবিদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হবে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে। পুরোদমে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। কোনো অনিয়মের সঙ্গে আপস করা হবে না।

প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ও প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের মতো সিনিয়র চিকিৎসকদের ঐ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ও ব্যবস্থাপনায় রাখা হতে পারে। বাংলাদেশের ডাক্তাররা বিদেশি ডাক্তারদের সমন্বয়ে চিকিৎসা ও অপারেশন পরিচালনা করবে। এতে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা আরো বাড়বে। তবে এখানে চিকিৎসাব্যয় হবে বেশি। যেমন চিকিৎসা, তেমন ব্যয়। এটা থাকবে ভিসির অধীনে।

প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন চিকিৎসা বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিয়ে যেতে। সেখানে থাকবে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণা। এই হাসপাতালের প্রথম ভিসি ছিলেন অধ্যাপক ডা. কাদরি। শুরুতে তিনি সুন্দরভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। পরবর্তী ভিসিরাও (অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের আগ পর্যন্ত) চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখেন। রোগীদের আস্থাও বেড়ে যায়।

প্রতিদিন বাড়তে থাকে রোগীর চাপ। প্রখ্যাত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ভিসি থাকাকালে এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোর পাশাপাশি চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণার মান উন্নয়নও বৃদ্ধি করেন। যার সুনাম দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে দুর্নীতির রেকর্ড করেন অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। চিকিৎসাসেবার মান নিচের দিকে নিয়ে যান তিনি। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। নিয়োগ, পদোন্নতিসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুর্নীতি করেননি ঐ ভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান তলানিতে নিয়ে যান। প্রতি নিয়োগে ২০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। সিন্ডিকেট করে হাসপাতাল পরিচালনা করেন। দুদকেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।

এদিকে আমলারা চাচ্ছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে ডাক্তাররা বলেন, এটা ঠিক হবে না। হাসপাতালটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে আছে এবং এভাবেই থাকবে। কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে থাকা সারা দেশের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। দুর্নীতি ও অনিয়ম নেই, এমন কোনো হাসপাতাল ও বিভাগ নেই। মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও তেমন কোনো জবাবদিহি নেই।

এ কারণে এসব স্থানে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিও চলছে সমান তালে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা অনুপস্থিত থাকছেন। ওষুধ থাকার পরও রোগীরা ওষুধ পান না। পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও রোগীরা এই সেবা পান না, অর্থাৎ জবাবদিহি ও মনিটরিংয়ের ঘাটতির কারণে এই অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানান। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে স্বাচিপ ও বিএমএ গ্রুপিং-এর কারণেও চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। আর এই প্রশাসন কিনা একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের খবরদারি করবে। এদিকে ডাক্তার-নার্সদের পদোন্নতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চলছে। নিয়ম অনুযায়ী কেউ কোনো পদোন্নতি পাচ্ছে না। অনেক মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকদের পদ শূন্য দীর্ঘদিন ধরে। এই প্রশাসনের হাতে এখন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পরিচালিত হলে, সেটার যে কী অবস্থা হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, মন্ত্রণালয়ের অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল হলে, ‘যে লাউ, সেই কদু হবে’। নতুন ভিসির চ্যালেঞ্জ— মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাসেবা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা এবং রোগীর আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালকে ঢেলে সাজানোও ভিসির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button