দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরে কি ব্যবস্থা নেবে?
সম্প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংসদে সরব হয়েছেন খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে যে অভিযোগ করা হচ্ছে সে বিষয়ে তেমন কোন জোরালো বক্তব্য নেই আওয়ামী লীগ নেতাদের। তবে দুর্নীতিবাজদের ধরতে হবে এমন আওয়াজ আওয়ামী লীগের সব স্তর থেকেই উঠে আসছে। এখন রাজনৈতিক মহলে এমন প্রশ্ন উঠেছে যে, দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তাদের বিচার করতে গেলে দলীয় যারা দুর্নীতিবাজ তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ব্যবস্থা নিলে তো দল থেকেই শুরু করতে হবে। জিরো টলারেন্স হলে তো সব ক্ষেত্রেই হতে হবে। কারণ আইন তো সবার ক্ষেত্রে সমান।
গত শনিবার সংসদে চলতি অর্থ বছরের বাজেট নিয়ে সাধারণ আলোচনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি, সে যেই হোক দুর্নীতি করলে কারো রক্ষা নেই।
যারাই দুর্নীতি করবে ধরবো। আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মাটিতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পেছনেও দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের মতো কারণ উঠে আসে। এতে বিব্রত হয় আওয়ামী লীগ। অপরদিকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমানের দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের খবর সংবাদমাধ্যমে আসে। একই সঙ্গে আসে তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার সংবাদও। যিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত একজন চেয়ারম্যান। অপরদিকে তিনি আওয়ামী লীগের জেলা আওয়ামী লীগের দুর্যোগ ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হন। ইতোমধ্যে মতিউরে সঙ্গে তার প্রথম স্ত্রী ও ছেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে আদালত। যার প্রত্যাহার চেয়ে তিনি গতকাল রোববার আদালতে আবেদনও করেছেন। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, লায়লা কানিজের দলের উপজেলা চেয়ারম্যান হবার বিষয়টি নিয়ে এখন দ্বিধা-বিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা এ ক্ষেত্রে একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন।
লায়লা কানিজের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া প্রসঙ্গে গত শনিবার রাতে এক টক শোকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, যখন তথ্য বের হয়ে আসে তখন আমার দল অ্যাকশন নেয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যারা দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি কমাতে পারে।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী ফোরামের নেতারা বলছেন, সরকারি কর্মচারিদের দুর্নীতি ধরতে গেলে দলীয় শৃঙ্খলা অনেক বেশি জরুরি। এ ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী, সৎ নেতাদের আবারও ধীরে ধীরে দলের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্বে আনার প্রক্রিয়া নিতে হবে। আর দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী, দলের ভেতর সুবিধাবাদী, লুটেরা এবং দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ইতোমধ্যে দলে শুদ্ধি অভিযানের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য মতে, ক্রাকডাউন হবে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী এবং দলের সুনাম নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলের ভেতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, দলের ভেতরের কোন্দল, বিভক্তি এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দলকে ব্যবহার করা, দলের স্বার্থ ক্ষুণœ করা এই সমস্ত বিষয়গুলোকে একেবারেই বরদাশত করা হবে না। আওয়ামী লীগের ভেতর যারা কোন্দল সৃষ্টি করছেন, যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করছেন এবং বিভিন্ন এলাকায় মাই ম্যান তৈরি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, যেসব মন্ত্রী, এমপি এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দলের শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেছেন উপজেলা নির্বাচনে এবং জাতীয় নির্বাচনের পর এলাকায় কোন্দল জিইয়ে রেখেছেন তাদের সঙ্গে সরাসরি দলীয় হাইকমান্ড কথা বলবেন, সতর্ক করবেন এবং কোন্দল মিটিয়ে ফেলার জন্য একটি আল্টিমেটাম দেবেন। এই সময়ের মধ্যে যদি তারা কোন্দল না মেটায় এবং সহিংসতার পথ থেকে সরে না আসে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশন গ্রহণ করা হবে।
আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয়স্বজনদের নির্বাচনে না দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেই আহ্বানেও সাড়া দেয়নি মন্ত্রী-এমপিরা। এখন দেখা হবে কোন কোন সংসদ সদস্য কোথায় কোথায় কী কী অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি দলীয়ভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আগামী বছরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগেই সময় নিয়ে দলকে ঢেলে সাজাতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এই সময়ের মধ্যে যারা জনবান্ধব, জনগণের পাশে থাকছে তাদের দলীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসা হবে। আর যারা এলাকায় নানা ধরনের অবৈধ আধিপত্য বিস্তার করছেন তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারা বিভিন্নভাবে দুর্নীতিপরায়ণতার সঙ্গে জড়িত তাদের নামের তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে দেওয়া হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান আওয়ামী লীগে চলবে কি না?
দলীয় দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে দলের এক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বলেন, এ বিষয়ে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভালো বলতে পারবেন। তবে জিরো টলারেন্স সেটা সব জায়গাতেই জিরো টলারেন্স নীতি হতে হবে।
গত শনিবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এই উপমহাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগে যদি কোনো আবর্জনা-আগাছা হাজির হয়, তবে তা আমরা উপড়ে ফেলব। আগাছামুক্ত আওয়ামী লীগ গড়ব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাছিম ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। যাকে বলা যেতে পারে শুভ জাগরণ। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান তো সকলের জন্যই হবে। কারণ আইন তো সকলেই ক্ষেত্রে সমান।
দলীয়ভাবে দুর্নীবাজদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া হবে তার কোন কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলের কেউ দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করা হবে। আর সন্ত্রান, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এ গুলোও তো দুর্নীতির অংশ। দলীয়ভাবে কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।
বেনজীর-আজিজ-মতিউর ইস্যুতে শুরু থেকেই সোচ্চার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুরুর দিকে দলীয় ফোরামের একাধিক সভায় সরকারের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি পুনর্ব্যক্ত করে ‘বেনজীর-আজিজ আওয়ামী লীগের লোক নন’ এবং তাদের বিচার চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গত বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান জিরো টলারেন্স। তিনি এক্ষেত্রে অটল। দুর্নীতি যেই করুক এক্ষেত্রে সরকার জিরো টলারেন্স। দুদকের দুর্নীতির তদন্ত করার অধিকার রয়েছে। এখানে সরকার তাদের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।