Hot

‘দুর্নীতি উন্নয়ন একসঙ্গেই চলেছে’

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের সফলতা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি স্থায়ী দুর্নীতিও এগিয়েছে। উন্নতি আর দুর্নীতি দুটোই পাশাপাশি এগিয়েছে। সাফল্যের বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক বেশি। গতকাল বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

সিপিডির ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ-ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বইটি সম্পাদনা করেছেন ড. রেহমান সোবহান ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রওনক জাহান।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও নির্বাচন কমিশনের মতো জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেছেন বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ ও সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা গণতন্ত্রের অবক্ষয় দেখছি।’

বইটিতে সেলিম রায়হান লিখিত অধ্যায়ের ওপর আলোচনায় ড. রেহমান সোবহান বলেন, ‘আমাদের দেশের উন্নয়নে অনেক ফাঁক আছে। তিনি (সেলিম রায়হান) প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা তুলে ধরেছেন। সেখানে বিচারব্যবস্থা কেমন চলে সেটি দেখানো হয়েছে। সবাই কি আদালতে গিয়ে সমান সুযোগ পায়? সমান অধিকার পায়? পুলিশের কাছে গেলে তারা কি সবাইকে সমানভাবে সেবা দেয়? ব্যাংকে গেলে কারা রাইট অফ করার সুযোগ পায়। দেশের

কোথাও ফাংশনিং ইনস্টিটিউশন (কার্যকর প্রতিষ্ঠান) নেই। একই কথা নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়েও।’

দেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকট তুলে ধরে এ প্রবীণ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ সংকট শুধু সুশাসনের অভাবে। এখন আর্থিক খাতকে শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে। তার মতে, গত ২৫ বছরে কী ধরনের পরিবর্তন জায়গা দখল করেছে সেটি এখানে দেখার বিষয়। ২৫ বছর আগে আরেকটি প্রকাশনা যখন প্রকাশ করা হয়েছিল, ওই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সে জায়গাটি এখন খুব বেশি বলার মতো নয়। সে সময় আরএমজি খাতের কাপড় বাইরে থেকে আসছিল, ঠিক সে সময় পণ্যের বৈচিত্র্যায়ন ছিল না। দেশের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কোনো উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করতে পারেনি। প্রবাসীরা যাচ্ছেন আসছেন, কিন্তু এখানেও বিরাট কোনো বুম হলো না।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিচারপতি হাবিবুর রহমান দায়িত্ব নিয়ে একটি নির্বাচন করলেন। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় এসেছিল। তখন দক্ষিণ এশিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কীভাবে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করতে হয়, সেটি রোল মডেল হিসেবে দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখনকার পরিস্থিতিতে গত দুই বছরে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে ২০ বছর ধরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম চলছে। গণতন্ত্রই উন্নয়নের প্রধান চালিকা।

নতুন একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাজনীতিতে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে এখানে ভালো নির্বাচন হতো। যে পদ্ধতি পাকিস্তান ও নেপাল গ্রহণ করেছিল। দুই দলের রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা হয়েছিল। এখন আমরা কী দেখছি? গণতন্ত্রের অবক্ষয় হচ্ছে বলে এ অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেন।’

রওনক জাহান বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এরকম আরেকটি বই করা হয়েছিল। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় যাবে। তখন অর্থনীতি নিয়ে অতটা উচ্চাশা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে বরং অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। তিনি আরও বলেন, পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। সেটা হলো, পরিবর্তনের জন্য মূল্য দিতে হয়।

বইটির বিভিন্ন অধ্যায় যারা রচনা করেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সশরীরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে বিভিন্ন দেশ থেকে অনলাইনে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে; উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার; এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন।

তিনি আরও বলেন, দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সরকার যে সবকিছু করে দিয়েছে, তা নয়; বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এখন এ সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বইয়ের একটি অধ্যায়ের লেখক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘৫০ বছরে আর্থসামাজিক বিভিন্নভাবে উত্তরণ হয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে কয়েকটি বিষয় দ্বিতীয় প্রজন্মকে চ্যালেঞ্জের সামনে নিয়ে গেছে। মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আমরা সামনে টেকসই হব কি না, মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ব কি না, সেটিই এখন চিন্তার বিষয়।’

বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কি না এমন সংশয় জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এতদিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেতে হবে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা যে রপ্তানি দেখি তাতে উচ্চ কারিগরি উপাদান মাত্র ১ শতাংশ, কিন্তু আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামে তা ২৫ শতাংশের বেশি। ব্রাজিল, ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো এখনো মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে আছে।’

বইয়ের আরেক লেখক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘সাফল্যের বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক বেশি। এ মুহূর্তে আমরা ধোঁয়াশায় আছি, আমরা কি এফডিআই নিয়ে এগোব নাকি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে এগোব।’

বাংলাদেশে এখন সংস্কার জরুরি, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘স্থায়ী দুর্নীতি উন্নতির সঙ্গে একইভাবে এগিয়েছে। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজরা এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের চক্র ভাঙার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। ব্যাংকে ও বিচারব্যবস্থায় আমরা উন্নতি করার বদলে নিম্নগামিতা দেখেছি।’

আরেক লেখক অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, ‘দারিদ্র্যের হার কমা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অসমতা বেড়েছে কেন আমি তা বইয়ে লেখার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে গরিবের উন্নতি শামুকের গতিতে আর ধনীদের রকেট গতিতে হয়েছে। শ্রমিকের গড় উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে, সে হারে মজুরি বাড়েনি।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দুর্নীতি এখন ধনীদের মূল এজেন্ডা। তারা দুর্নীতি করে নিজের নিরাপত্তার জন্য।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির বাইরে আরও কিছু বিষয় দেশের উন্নয়নে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সেটা হলো, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিপ্লব; মানুষের মধ্যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকা বা লড়াই করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা। এ প্রবণতার কারণে দেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এর মধ্যে দেশের উন্নয়নের জগতে বড় একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে বলে মনে করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। সেটা হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক দূরদৃষ্টি থেকে বর্জনকামী দূরদৃষ্টি। সেজন্য তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক এজেন্ডা রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপান্তরিত হবে।

হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘আমরা এখন সস্তা শ্রমে আটকে গেছি। আগামীর অর্থনৈতিক এজেন্ডা হতে হবে রাজনৈতিক।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উন্নয়ন হয়েছে ভবিষ্যৎকে বন্ধক রেখে। আমরা উঠতেও পারি, পিছলাতেও পারি।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কীভাবে উন্নয়ন হলো, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়। বরং উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না, এখন সেটা বুঝতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d