Hot

দেনা-লোকসানে পিডিবি, তবু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের পাওনা দুই বছর ধরে পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে। বছরে লোকসান ছাড়িয়ে গেছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ পটভূমিতে সরকার বন্ড ইস্যু করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসবই হচ্ছে চাহিদার চেয়ে বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। বাড়তি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। গত অর্থবছরে ১৭ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের। তবু নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, পুরোনো কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ছে। নতুন আরও প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

গত মার্চে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, গ্রাহক সেভাবে বাড়েনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে ১৬.০৪ শতাংশ, বিপরীতে গ্রাহক বেড়েছে ৬.৩৫ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকার কারণে সরকারকে খরচ করতে হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা। উচ্চ উৎপাদন খরচ মেটাতে সরকারকে বারবার বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে। তিনি বলেন, বিশ্বের নানা দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ চাহিদার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি রাখাই নিয়ম, যাকে রিজার্ভ মার্জিন বলা হয়। এটি মূলত অব্যবহৃতই থাকে। তবে বাংলাদেশে রিজার্ভ মার্জিন ৩৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা-২০১৬ অনুসারে ২০২৪ সালে বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছিল ২০ হাজার ১২৯ মেগাওয়াট। সে অনুসারে ২০ শতাংশ রিজার্ভ মার্জিন ধরে উৎপাদন সক্ষমতা হওয়ার কথা ২৪ হাজার মেগাওয়াট, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। অর্থাৎ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অতিরিক্ত সক্ষমতা রয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াট।

তারা বলেন, মহাপরিকল্পনার চেয়ে বাস্তবতা ভিন্ন। বিদ্যুৎ বিভাগ এ বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরেছে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, যদিও সর্বোচ্চ উৎপাদন এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এই অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। এতে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ; বেড়েছে পিডিবির লোকসান। 

খাত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০১৮ সালে একবার সংশোধন করা বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও শক্তিশালী করতে নির্দিষ্ট হারে রিজার্ভ মার্জিন থাকা জরুরি। তবে অপরিকল্পিত ও আগ্রাসী সক্ষমতা বাড়ার ফলে রিজার্ভ মার্জিন বেড়ে গিয়ে দেশের অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে। ২০২৩ সালে প্রণীত ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০৩০-এর দশকে বিদ্যুতের অতিরিক্ত সক্ষমতা (রিজার্ভ মার্জিন) হবে ৩০ শতাংশ। আর ২০৪০ সালের আগে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা ২০ শতাংশের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা নেই। 
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ার মূল কারণ ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতা।

তিন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে, আরও বাড়বে ক্যাপাসিটি চার্জ

নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে ইউনিক গ্রুপের ৫৮৪ ও সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যাপ্ত গ্যাসের কারণে এখনও ঠিকমতো চালু হয়নি। কাছাকাছি অবস্থিত ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার ও জাপানের জেরা ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে। গ্যাস পাওয়া সাপেক্ষে এটিও শিগগির চালু হবে। দেশের গ্যাস সংকটে আদৌ এ কেন্দ্রগুলো ঠিকমতো চলবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এ তিন কেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে হলে প্রতিদিন ৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাস লাগবে। এর মধ্যে সামিট ও ইউনিকের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক গ্যাস দরকার ১৯ কোটি ঘনফুট। রিলায়েন্সের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজন দৈনিক ১৩ কোটি ঘনফুট। গ্যাস না পেলে বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে না। তবে চুক্তি অনুসারে ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই পাবেন উদ্যোক্তারা।

গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৩টি আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী) ও ৩০টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সামিট গ্রুপ। কোম্পানিটি ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভাড়া পেয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল সাত কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ইউনাইটেড গ্রুপ ছয়টি কেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এই চার্জ আরও বাড়বে। 

লোকসান আকাশ ছুঁয়েছে

পিডিবি গত ১৫ বছরে (২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত) লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ দুই অর্থবছরে (২০২১-২২ ও ২০২২-২৩) ৮৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনেছিল মাত্র ৮২৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। 

দেনা সামলাতে বন্ড

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের পাওনা দিতে পারছে না পিডিবি। এ বকেয়া ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এসব পাওনা টাকার বিপরীতে ২৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ২৮টি ব্যাংকের অনুকূলে গত ফেব্রুয়ারিতে ১০ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। নতুন করে এখন আবার ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ঈদের আগে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু নগদ টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না, তাই বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হচ্ছে। আশা করছি, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদেরও ব্যাংক ঋণের চাপ কমবে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকরা বলছেন, বন্ড ইস্যুতে ব্যাংক ঋণের চাপ সামলে ওঠা যাচ্ছে। তবে বন্ড দিয়ে ব্যাংকগুলো জ্বালানি তেল বা প্রয়োজনীয় অন্য জিনিস আমদানিতে নতুন এলসি খুলতে চাচ্ছে না। 

নতুন আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র

বাড়তি সক্ষমতার মধ্যেই আরও বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে বর্জ্য ও ময়লা থেকে ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং জামালপুর ও চট্টগ্রামে দেশের সবচেয়ে বড় ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে যাচ্ছে। ২০ বছরে এই তিন কেন্দ্র থেকে সরকারের বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হবে ১৮ হাজার ৪১৩.২ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এ তিনটি কেন্দ্র স্থাপিত হবে। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রকল্পগুলো সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে। ডিপি ক্লিন টেক ইউকে লিমিটেড এবং ইমপেক্ট এনার্জি গ্লোবাল লিমিটেড কনসোর্টিয়াম ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৬ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি স্থাপন করবে। কিলোওয়াটপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ২৩ দশমিক ২১ টাকা। জামালপুরের ইসলামপুরে ৯০২ দশমিক ৩৫ একর জমির ৩০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নির্মাণ করবে বাংলাদেশ ও বিদেশি যৌথ উদ্যোগে সেল-জিটেক পাওয়ার। কিলোওয়াটপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ১০ টাকা। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে বাংলাদেশ ও হংকংয়ের যৌথ উদ্যোগে প্রাইভেট কনসোর্টিয়াম অব হিউইহেগ উইং পাওয়ার লিমিটেড হংকং এবং জুপিটার এনার্জি। কিলোওয়াটপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৮১ টাকা। 

বাড়ছে পুরোনো কেন্দ্রের মেয়াদ

আশুলিয়া, মাধবদী ও চান্দিনায় সামিট পাওয়ারের মোট ১১১ মেগাওয়াটের তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়িয়েছে সরকার। সম্প্রতি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে মেয়াদ বাড়ানোর এ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর শেষ হয়ে গিয়েছিল। সূত্র জানিয়েছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের ট্যারিফ ৬ টাকা শূন্য ৪ পয়সা হিসাবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছিল।
 
কী বলছেন সচিব

এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এ চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগবে। অনেক বিদ্যুৎ প্রকল্প আগে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে উৎপাদনে আসছে। আর বর্তমানে যেসব প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, এগুলোর অধিকাংশই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। তিনি বলেন, পিডিবির লোকসান কমাতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে, এর বিকল্প নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button