দেশি কম্পানির দাপট এসির বাজারে
অসহনীয় গরমে স্বস্তি খুঁজতে উচ্চবিত্তের পাশাপাশি এখন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষও ঝুঁকছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের (এসি) দিকে। ফলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসির শোরুমগুলোতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। ব্যাপকভাবে বেড়েছে এসির বিক্রি।
বিক্রয়কর্মী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এসি এখন আর বিলাসী কোনো পণ্য নয়, এটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে।
প্রচণ্ড গরম থেকে রেহাই পেতে এখন সব ধরনের মানুষ এসি কিনছেন। এবার ঈদুল ফিতরের কিছুদিন আগে থেকে এসি বিক্রি শুরু হলেও ঈদের পর থেকেই ব্যাপক হারে বেড়েছে বিক্রি। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এসির বিক্রি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ডলারের বাড়তি দাম ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে চলতি বছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কম্পানিগুলোর এসির দাম বেড়েছে, তবে কেউ কেউ দাম বাড়ায়নি।
বর্তমানে দেশে ওয়ালটন, সিঙ্গার, মিনিস্টার, ভিশন, র্যাংগস, বাটারফ্লাই, ইলেক্ট্রোমার্ট, এসকোয়্যার, ট্রান্সকম, ইলেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল, এলজিসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসি উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে বছরে সাড়ে পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়। বর্তমানে এসির চাহিদার প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ দেশেই তৈরি হয়। গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মানের ক্ষেত্রে দেশে তৈরি করা এসি অনেকাংশে আমদানি করা এসির তুলনায় ভালো।
দামে সাশ্রয়ী ও মানে আন্তর্জাতিক, দীর্ঘমেয়াদি ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি, সহজে খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা ও বিক্রয়োত্তর ফ্রি সার্ভিসিং সুবিধার কারণে দেশে উৎপাদিত এসির প্রতি গ্রাহকদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
ওয়ালটনের এসির ডেপুটি চিফ বিজনেস অফিসার সন্দ্বীপ বিশ্বাস বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এসি বিক্রি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। ওয়ালটন এসির আফটার সেলস সার্ভিস, মডেলের ভিন্নতা, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এবং এফোর্ডেবল প্রাইজ হওয়ায় অন্যদের তুলনায় ভালো সাড়া পাচ্ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এসির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরির বেসিক যে কাঁচামালগুলো আমাদের ক্রয় করতে হয় সেসবের দাম বেড়েছে। এতে এসির উৎপাদন খরচও বেড়েছে।
তার পরও আমরা লাভ কমিয়ে এসির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করেছি। এসির বাজারে ৩৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে ওয়ালটন।’
জানতে চাইলে র্যাংগস ইলেকট্রনিকসের হেড অব ডিলার রওশন আলী রিপন বলেন, ‘এবার এসির ব্যাপক চাহিদা বাজারে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বিক্রি বেশি হচ্ছে। চাহিদা বাড়লেও এ বছর র্যাংগস ব্র্যান্ডের এসির দাম বাড়ানো হয়নি, তবে কিছু এসির দাম আমরা কমিয়েছি। এবার বাজারে এসির ভালো চাহিদা থাকায় বছর শেষে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করছি।’
চীনের তৈরি গ্রি ব্র্যান্ডের এসির বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রোমার্টের সিনিয়র ম্যানেজার এনামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘এখন আবাসিক এসির বিক্রি বেড়েছে। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় ইনভার্টার এসি বিক্রি বেশি হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় গত বছরের তুলনায় এসির দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাসাবাড়ির জন্য মানুষজন দেড় টনের এসি বেশি কিনছে।’
স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের কনজিউমার ইলেকট্রনিকস ডিভিশনের হেড অব বিজনেস (ডিরেক্টর) শাহরিয়ার বিন লুৎফর বলেন, ‘সারা দেশে চলা তীব্র দাবদাহে এখন স্যামসাং এসির চাহিদা তুঙ্গে রয়েছে। স্যামসাং এসি সর্বাধুনিক ফিচারসমৃদ্ধ এসি। স্যামসাংই বিশ্বের একমাত্র এসি, যার রয়েছে উইন্ড ফ্রি ফিচার। এ ছাড়া অন্য সব সুযোগ-সুবিধা তো রয়েছেই।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে স্যামসাংয়ের এক টন স্টেপ-আপ এসির দাম ৮০ হাজার ৯০০ টাকা। দেড় টন স্টেপ-আপ এসির দাম এক লাখ তিন হাজার ৯০০ টাকা, দুই টন স্টেপ-আপ এসি এক লাখ ১৫ হাজার ৯০০ টাকা, এক টন উইন্ড ফ্রি এসি ৮৪ হাজার ৯০০ টাকা, দেড় টন উইন্ড ফ্রি এসি এক লাখ সাত হাজার ৯০০ টাকা এবং দুই টন উইন্ড ফ্রি এসির দাম এক লাখ ২০ হাজার ৯০০ টাকা।’
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ভিশন ব্র্যান্ড নামে বাজারে এসি বাজারজাত করছে। জানতে চাইলে কম্পানিটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘রাজধানী ও ঢাকার বাইরে ভিশন এসির চাহিদা অনেক বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও চলতি বছর ভিশন এসির দাম বাড়েনি। আগের নির্ধারিত দামেই বাজারে ভিশন এসি বিক্রি হচ্ছে।’
সরেজমিন চিত্র
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসির শোরুম ঘুরে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি বেশ কিছু ব্র্যান্ড ক্রেতা আকর্ষণে এসি বিক্রিতে বিশেষ অফার দিয়েছে। নগদ টাকায় এসি কিনলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্টও দিচ্ছে কিছু কম্পানি। প্রায় সব ব্র্যান্ডের এসিতে রয়েছে কিস্তির সুবিধাও। ছয় থেকে ১২ মাসের কিস্তিতে পরিশোধ করা যাচ্ছে এসির দাম।
রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকায় ওয়ালটন শোরুমের ম্যানেজার মোস্তফা কামাল সোহাগ বলেন, ‘মূলত এবার ঈদের পর থেকেই ব্যাপকভাবে এসির বিক্রি শুরু হয়েছে। এবার প্রচণ্ড গরমের কারণে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি এসি বিক্রি হয়েছে। বিদ্যুৎ খরচ কম হওয়ায় এখন ইনভার্টার এসির চাহিদা বেশি। প্রতি ১০০টি এসির মধ্যে ৯৫টি ইনভার্টার এসি বিক্রি হচ্ছে। ওয়ালটনের যেকোনো এসিতে ১০ শতাংশ নগদ ডিসকাউন্ট সুবিধা রয়েছে। ৩৬ মাসের কিস্তির সুবিধায় এসি কেনার সুযোগ রয়েছে।’
রাজধানীর বাড্ডায় বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেডের শোরুমের বিক্রয়কর্মী মো. শামীম মিয়া বলেন, ‘আমরা বর্তমানে এলজি, ইকো প্লাস ও হায়ার ব্র্যান্ডের এসি বিক্রি করছি। এ বছর ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও প্রচুর এসি বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর এলজি, ইকো প্লাস ও হায়ার ব্র্যান্ডের প্রতিটি এসিতে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।’ বাটারফ্লাইয়ের সব শোরুমে ‘ব্রিং হ্যাপিনেস অফার’ চলছে। পাঁচ হাজার টাকার ওপরে যেকোনো পণ্য কিনলেই নিশ্চিত ক্যাশব্যাক অফার রয়েছে বলেও তিনি জানান।
রাজধানীর রামপুরা এলাকার সিঙ্গারের শোরুমে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী মো. ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাসায় আমার এক বছর ও চার বছরের দুটি বাচ্চা আছে। আগে এয়ারকুলার ছিল, দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার কারণে সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অসহ্য গরমে বাচ্চাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। দিনের বেলা ফ্যানের গরম বাতাসে রুমে বাচ্চাদের নিয়ে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে দেড় টনের একটি এসি দেখতে এলাম। যেখানে দাম কম পাব সেখান থেকেই কিনে নিয়ে যাব।’