Trending

দেশের অর্থনীতির সব সূচক নিম্নমুখী

দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো সুখবর নেই। কমেছে রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, প্রবাস আয় ও বৈদেশিক সহায়তা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখন সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রিজার্ভ রক্ষা করা। পাশাপাশি প্রয়োজন বৈধ পথে প্রবাস আয় বাড়ানো।

চলতি অর্থবছরে সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মঙ্গলবার তাদের প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৬ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে। এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫.৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি বাড়ার চারটি কারণ দেখিয়েছে।

যেমন : দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটা ও আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সংকট চলমান তার দায় যে শুধু বৈদেশিক কারণ, বিষয়টি এমন নয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিনের সমস্যা জমে থাকার কারণে এখন তা বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে।’

কমছে রিজার্ভ

ডলারের দাম বেঁধে দেওয়াসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। ডলার সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ কমছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (তিন মাসে) রিজার্ভ কমেছে ৪৪৬ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১২০ কোটি ডলার বা প্রায় ৩১.২ বিলিয়ন ডলার। ৩ অক্টোবর তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৭৪ কোটি ডলার বা ২৬.৭৪ বিলিয়ন ডলার।

অবশ্য আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন দুই হাজার ৯০ কোটি ডলার ২০.৯ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃত রিজার্ভ আরো কম, ১৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

রিজার্ভ ধরে রাখাকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, যে পরিস্থিতি চলছে তাতে রিজার্ভ উদ্বেগজনক পর্যায়ে আছে বলা যায়। এখন এটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে।

তবে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান গত সোমবার এক আলোচনায় বলেছেন, রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে গেলে তা অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

কমেছে প্রবাস আয়

রিজার্ভ বাড়ানোর অন্যতম উৎস প্রবাস আয়। নতুন অর্থবছরের তিন মাসে এই প্রবাস আয় কমেছে। গত সেপ্টেম্বরে যা হয়েছে তাকে বড় পতন বলা যায়। এ মাসে মাত্র ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। গত ৪১ মাসের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন।

গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় রেমিট্যান্স ১৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার কম এসেছে। রেমিট্যান্স কমেছে ১২.৭২ শতাংশ। আর এ বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে কমেছে ১৬ শতাংশ। আগস্টে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।

এ বিপরীতে দেখা যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী প্রবাসে গিয়েছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য হলো, গত অর্থবছরে ১০ লাখ ৭৪ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশে গেছেন। এতে প্রবাস আয় বাড়ার কথা থাকলেও তা না হয়ে কমেছে। 

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রবাস আয় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। বৈধ চ্যানেলে সাধারণত ডলার পাঠালে ডলারপ্রতি দর দেওয়া হয় ১১০ টাকা। কিন্তু হুন্ডিতে প্রবাস আয় পাঠালে ১১৬-১১৭ টাকা পান প্রবাসীরা। কিন্তু হুন্ডি ব্যবস্থায় ডলার কর্মী যে দেশে কাজ করেন সে দেশে থেকে যায়। দেশে শুধু আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে টাকা লেনদেন হয়।

আবার অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, নির্বাচনের বছর টাকা পাচার বেড়ে যায়। টাকা পাচারেও প্রবাস আয় ব্যবহার হয়ে থাকে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এখন হুন্ডির মাধ্যমে দেশে প্রবাস আয় আসা কমাতে পারলেই কিছুটা হলেও সমস্যা সমাধান করা যাবে। আর কিছুটা দরকার নীতিমালা ঠিক করা।

বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় কমেছে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ—ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, এ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বিদেশি সহায়তা এসেছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের এ দুই মাসে এসেছিল ৮৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার।

বিদেশি ঋণ কম এলেও বেড়েছে ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধের চাপ। একই সময়ে ঋণের সুদ ও আসল মিলে পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হয়েছিল। গত দুই মাসে মূল ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এ সময় মূল ঋণ পরিশোধ করা হয় ২৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

শুধু সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার সুদ পরিশোধ করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে পরিশোধ করতে হয়েছে ৯ কোটি ২৮ লাখ ডলার।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাইপলাইনে এখনো ৫০ বিলিয়নের মতো ডলার আটকে আছে। এগুলো ছাড় না হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন সময়মতো না হওয়া। এই অর্থ ছাড় করতে শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নয়ন সহযোগীদেরও সহায়তা দরকার হবে।

রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ কম

বৈদেশিক অর্থের অন্যতম প্রধান উৎস রপ্তানি আয়েও কোনো সুখবর নেই। চলতি অর্থবছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—প্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা আশা জাগাতে পারছে না। মাসিক হিসাবে রপ্তানি আয়ের চিত্র ওঠানামা করছে।

গত জুলাই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ৪৭৮ কোটি ডলার। কিন্তু সেপ্টেম্বরে আবার কমে হয়েছে ৪৩১ কোটি ডলার।

গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত—এই তিন মাসে বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ২৯.৪৯ শতাংশ। মোট ৬২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে এই সময়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এফডিআইয়ের সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগে সহায়ক নীতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে। সামনে নির্বাচন। এরপর সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আসে কি না, তা তাদের মাথায় রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণত বিনিয়োগ কমই হয়ে থাকে।

উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি, ভুগছে মানুষ

নিম্ন আয়ের মানুষকে এক বছরের বেশি সময় ধরে ভোগাচ্ছে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় এবং এই বছরের শুরু থেকে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারেনি। বরং খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে, যা এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মূল্যস্ফীতির হিসাবে গত এক বছরে মানুষের খরচ ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ বছর সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, ১২.৫৪ শতাংশ।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে করণীয় প্রসঙ্গে সিপিডির রিসার্চ ফেলো মুনতাছির কামাল বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারকে বহুমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংক খাতের সংস্কার। প্রথম কাজটি হলো, সরকারকে সুদের হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। বাজারভিত্তিক সুদহার হলে তা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, খেলাপি ঋণ কমানো। ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে। যাতে খেলাপি ঋণ অনেকাংশে কমে যাবে। তৃতীয় বিষয়, রিজার্ভ ধরে রাখা আর প্রবাস আয় বাড়ানো।

মুনতাছির কামাল বলেন, হুন্ডি বন্ধে কঠোর নজরদারি করতে হবে। হুন্ডিতে মানুষ টাকা পাঠাচ্ছে, কারণ হলো টাকা বেশি পাচ্ছে। তাই বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এতে পুরোপুরি সমাধান না হলেও কিছুটা সমাধান হতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button