দেশে নতুন বিপর্যয়ের শঙ্কা

ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর দুই দেশের মধ্যে যে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলছে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। হামলার পর পরই তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলে নিয়ে নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম- যেমন সরকারি বন্ড ও সোনার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। পশ্চিমা দেশগুলো আরেক দফা মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছে।
তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর। চলমান যুদ্ধ সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট ও উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইরানে বন্দর ও জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলার ফলে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে জ্বালানি খাতে। প্রথমত জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা, দ্বিতীয়ত মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা। বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে তেল-গ্যাসের দাম বাড়তির দিকে; এর ফলে দেশেও জ্বালানির দাম বাড়বে। এটি দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প খাতকে সবচেয়ে বেশি চাপে ফেলবে। এ ছাড়া জাহাজে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বাড়ার কারণে শিল্পের কাঁচামালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তাদের কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস। সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রভাব হতে পারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং এর ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির চাপ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে- ইরানের এমন তিনটি অবকাঠামো হচ্ছে বন্দর আব্বাস, সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্র এবং হরমুজ প্রণালি। বন্দর আব্বাস ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দর এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বুশেহর প্রদেশে অবস্থিত সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রটি ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতার অন্যতম প্রধান উৎস। এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর আব্বাস ও প্রাকৃতিক গ্যাস স্থাপনায় হামলা করেছে ইসরায়েল। আবার হামলার জেরে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইরান।
সেলিম রায়হান বলেন, হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জ্বালানি পণ্য পরিবাহিত হয়। এটি যদি সাময়িক সময়ের জন্যও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম দ্রুতগতিতে বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ একটি জ্বালানিনির্ভর দেশ। জ্বালানির একটি বড় অংশ আমদানি করে থাকে, বিশেষ করে এলএনজি ও পরিশোধিত তেল। তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব শিল্প উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি এবং ভোক্তা পর্যায়ের ওপর এসে পড়বে। এতে দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণ জনগণের জীবিকায় চাপ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে জ্বালানি আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হবে এবং টাকার মান দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। এতে আমদানি খরচ আরও বাড়বে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত হতে পারে।
এ ছাড়া হরমুজ প্রণালি বন্ধ থাকলে বিশ্বজুড়ে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে, যার ফলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই শিক্ষক। তাঁর মতে, বাংলাদেশ রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি হিসেবে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল; মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং চুক্তি বাতিলের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।