দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে ২৬ লাখ ৬০ হাজার
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে কমছে সাধারণ মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান। এর অন্যতম কারণ ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং উৎপাদন হ্রাস। সুদের হার বাড়ার কারণে আমানতকারীরা কিছুটা লাভবান হলেও ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। একদিকে উচ্চ সুদ দিতে চেয়েও আমানত পাচ্ছে না ব্যাংক, অন্যদিকে ঋণসংকটে পড়ছে বেসরকারি খাত।
বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে ধীরগতি এবং কর্মসংস্থান ঘাটতি দেশের অর্থনৈতিক সংকট বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাংকঋণের সুদের হার ক্রমাগতভাবে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর একমাত্র উপাদান সুদহার বৃদ্ধি নয়; আরো অনেক উপায় রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বা রেপো রেট আরো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদ।
এতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলসি খোলার হার কমেছে ৭ শতাংশ আর উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। দফায় দফায় ঋণের সুদহার বাড়ানোয় চরম সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাত। ফলে ব্যবসা প্রসারসহ থমকে রয়েছে বিনিয়োগ।
ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, দেশে এখন বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। বরং ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াই করছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত তুলে রাখছেন অনেক উদ্যোক্তা।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমনিতেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বেশি সুদ দিয়ে আসছিল। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ। কোথায় কত টাকা খরচ হবে এবং কতটা মুনাফা হতে পারে, সেটা হিসাব করে আমরা বিনিয়োগ করি। কিন্তু মাঝপথে যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।’
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আর অর্থনীতির ধীরগতিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমেছে। নভেম্বরে এই হার দাঁড়িয়েছে ৭.৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে কভিড মহামারির মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭.৫৫ শতাংশে নেমেছিল।
সরকার পতনের পর নতুন নতুন নীতিমালা, শ্রমিক অসন্তোষ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনীতিকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মামলায় আসামি করা, মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিসহ নানা কারণে বিনিয়োগে নিম্নমুখী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছিল।
সূত্র জানায়, সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পথে হাঁটছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও। এবার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বা ১ শতাংশ সুদ বাড়ানো হতে পারে। বিষয়টি আগাম আঁচ করতে পেরে ব্যবসায়ী নেতারা গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে বিদ্যমান সুদহার কমাতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
দেশের কর্মে নিয়োজিত বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ( বিবিএস)। সেখানে বলা হয়, কৃষি, সেবা ও শিল্প—সব খাতেই কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। নারীর চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি বেড়েছে।
গেল বছরের শুরুতে দেশে বেকারের সংখ্যা কম থাকলেও বছর শেষে ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা বেড়েছে। মূলত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাবে বছরের শেষ সময়ে বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার।