দেশে মানসিক রোগীর ৯৩ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে
রাজধানীর শ্যামলীর বাসিন্দা নাছিমা বেগম তাঁর মেয়ে আরফিন সুলতানাকে (১৭) দুই হাত বাঁধা অবস্থায় নিয়ে আসেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। নাছিমা জানান, ১৫ দিন আগে তাঁর মেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ঘুম থেকে উঠে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। খুব রাগারাগি করে। খাওয়া-দাওয়া করে না। হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। তাদের ধারণা, আরফিন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত।
নারায়ণগঞ্জ থেকে কোহিনূর ইসলাম তাঁর ছেলে মাহাদী হাসানকে (১৭) নিয়ে এসেছেন একই হাসপাতালে। কোহিনূর বলেন, দুই বছর আগে তাঁর ছেলের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে এমন অবস্থা। এখন সারাক্ষণ বাসায় তার কক্ষে বসে থাকে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কান্না করে। ওষুধ খেলে কিছুটা স্বাভাবিক থাকে। তবে ওষুধ খাওয়ানো যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে এর আগেও তিনবার এসেছি। চিকিৎসক জানিয়েছেন, এ সমস্যাটা হলো বাইপোলার ডিজঅর্ডার।
আরফিন ও মাহাদীর মতো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সেবা নেওয়া ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী সিজোফ্রেনিয়া কিংবা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের। অন্য ৮ ধরনের জটিলতা নিয়ে এসেছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ রোগী। চিন্তাধারা এবং অনুভূতি প্রকাশে সংগতি না থাকাকে সিজোফ্রেনিয়া বলে। শৈশবে কোনো অস্বাভাবিকতা, অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকা, অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের শিকার কিংবা বিরূপ পরিবেশে বড় হলে সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। বাইপোলার ডিজঅর্ডার হলে কোনো ব্যক্তি কখনও কখনও দীর্ঘ সময় বিষণ্ন থাকেন, আবার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ শুরু করেন। কখনও কখনও অতিরিক্ত হাসিখুশি বা উচ্ছ্বাসপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ২০০১ সাল থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত মানসিক অসুস্থতা নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ১৩ লাখ ৫৭ হাজার জন। ভর্তি রেখে ৫৯ হাজার ৮২৯ জন এবং জরুরি বিভাগে ৫৬ হাজার ৫৪১ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত আট মাসে এই হাসপাতালে ১৩ হাজার শিশুসহ সেবা নিয়েছেন ৭৪ হাজার ১৩৬ জন। তাদের মধ্যে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৩ জনকে।
দেশে বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা অধিক হারে মানসিক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ১২ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। এর অধিকাংশই চিকিৎসার বাইরে। মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে অর্ধেকেরই জটিলতা শুরু হয় ১৪ বছর বয়স বা তারও আগে। অসুস্থদের ৯৩ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানসিক রোগী সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা না পেলে বিষণ্নতার এক পর্যায়ে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইনে গাদাগাদি করে রোগীদের স্বজন দাঁড়িয়ে আছেন। বিশেষায়িত এ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এখনই সময়’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
দেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত প্রায় দুই কোটি মানুষ। তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র ২২০ জন। তাদের মধ্যে একশর বেশি চিকিৎসক রাজধানীতেই অবস্থান করছেন। জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। সরকারি পর্যায়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য শয্যা আছে মাত্র ৮১৩টি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকোথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিজঅর্ডার গুরুতর মানসিক রোগ। এ দুই রোগে আক্রান্তদের ভর্তি রেখে সেবা দিতে হয়। পরিবার যখন এই রোগীদের বাড়িতে রেখে ব্যবস্থাপনা করতে পারে না তখনই হাসপাতালে নিয়ে আসে। শৈশবে নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশু পরবর্তী সময়ে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। এসব সমস্যা প্রতিকারে সামাজিক স্তর থেকে শিশুদের হতাশা দূর করতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিশুরা রাষ্ট্রের সম্পদ। তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটি আমাদের দায়িত্ব। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শিশু-কিশোরদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা জরুরি। তাদের মানসিক বিকাশে সুস্থ বিনোদন ও খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে।