Hot

দেশে সৌরবিদ্যুতে ব্যয় ৩ গুণ বেশি

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সৌরবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ বাড়ছে। বছরের বেশির ভাগ সময় সূর্যালোক থাকায় বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ভালো সম্ভাবনার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ এ দেশে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি। বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ক্রমে হ্রাস পেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন।

বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের চাপ পড়ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ (বিপিডিবি) পুরো বিদ্যুৎ খাতে।

বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে খরচ হচ্ছে ১৪ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ২২ টাকা ৩৮ পয়সা পর্যন্ত। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের তথ্য মতে, ভারতে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় গড়ে পাঁচ টাকা ৮১ পয়সা এবং পাকিস্তানে তিন টাকা ৫১ পয়সা। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে সোলার প্যানেলসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশের দাম কমে আসায় সৌরবিদ্যুতের ক্রয় চুক্তিগুলো আগের তুলনায় অনেকটাই কম মূল্যে করা হচ্ছে।

ফলে আগামী দিনে সৌরবিদ্যুৎ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব হবে।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারতের বিদ্যুৎ খাতে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকায় সেখানকার কম্কানিগুলো কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে। বাংলাদেশে এখনো প্রতিযোগিতা গড়ে না ওঠায় সৌরবিদ্যুতে খরচ পড়ছে ভারতের চেয়ে তিন গুণের বেশি। ক্রয় চুক্তিতে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনতে সরকারকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

এর পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণে সহায়তা, সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ ও সৌর যন্ত্রাংশ আমদানিতে আরো নীতি সহায়তা দেওয়ার  পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা।

বিপিডিবির গত মাসের (এপ্রিল-২০২৪) বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে দেশের ১০টি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ খরচ পড়া সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সাত মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট (প্রতি ইউনিটে খরচ ২২ টাকা ৩৮ পয়সা), জামালপুরের সরিষাবাড়ী তিন মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট (২০ টাকা ৮৭ পয়সা), ময়মনসিংহের সুতিয়াখালী ৫০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট (১৮ টাকা ৭০ পয়সা),  লালমনিরহাট ৩০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট (১৭ টাকা ৬০ পয়সা), দেশের সবচেয়ে বড় গাইবান্ধা ২০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট (১৬ টাকা ৫০ পয়সা)।

সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশে সর্বনিম্ন ব্যয় তেঁতুলিয়া আট মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্টের। সেখানে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ ১৪ টাকা ৩০ পয়সা, যা সর্বোচ্চ ব্যয়ের কাপ্তাই সাত মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্টের তুলনায় অনেক কম।

প্রসঙ্গত, সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ শর্তে বিদ্যুৎ কিনছে। এ কারণে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে কোনো ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয় নেই।

এ ব্যাপারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন খান বলেন, ‘বাংলাদেশের সৌরচালিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ২২ সেন্ট (১১ থেকে ২৪ টাকা), অথচ চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ পরিচালিত সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী যেকোনো সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের আদর্শ ট্যারিফ হওয়া উচিত মাত্র পাঁচ থেকে ছয় সেন্ট। প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য অবৈধ কমিশন বাণিজ্য, যার দায় গ্রাহকের ওপর চাপানো হচ্ছে। এটা শুধু অনৈতিক নয়, সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তরের বিপরীত অবস্থান। অতিরিক্ত দামে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সম্ভাবনার অপব্যবহার করা হচ্ছে। দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিযোগিতামূলক ট্যারিফ নির্ধারণ না করলে তা সবুজ অর্থনীতি বিকাশে সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।’

জানতে চাইলে জ্বালানি খাতবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিসিসের (আইইইএফএ) প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেশি হওয়ার মূল কারণ জমির উচ্চমূল্য, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, উদ্যোক্তাদের নিজস্ব অর্থায়নে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের বিধান এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না হওয়া। বৈদেশিক বিনিয়োগের অঙ্গীকার থাকার পরও জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় অনেক উদ্যোক্তাই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ভারতে জমি অধিগ্রহণে এত সমস্যা হয় না বলে সেখানে অত্যন্ত দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।’

শফিকুল আলম বলেন, ‘সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় সরকারকে বহন করা, জমি অধিগ্রহণ জটিলতা কমিয়ে আনাসহ প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা গেলে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ সাত থেকে আট টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায় ভবিষ্যতে দেশের গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের ওপর বড় প্রভাব পড়বে।’

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের উপপরিচালক (সাসটেইনেবল এনার্জি অ্যান্ড এসডিজি) কিউ এ সারহান সাদেক বলেন, ‘ভারতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য উদ্যোক্তারা বিনা মূল্যে ও স্বল্পমূল্যে জমি পায়। সরকার গ্রিড লাইনও করে দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের উচ্চমূল্যে জমি কিনতে ও নিজ খরচে গ্রিড লাইন নির্মাণ করতে হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে এখন সোলার প্যানেল, ইনভার্টারসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশের দাম কমেছে। এ কারণে নতুন চুক্তিগুলোতে ইউনিটপ্রতি ট্যারিফ ১০ থেকে ১১ টাকার বেশি ধরা হচ্ছে না। নতুন চুক্তিতে ট্যারিফ কমানোর সুফল আগামীতে পাওয়া যাবে।’

বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ এবং পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)-২০১৬ অনুযায়ী সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছিল। এই লক্ষ্য পূরণে বড় বাধা ছিল জমির স্বল্পতা। ২০১৬ সালে পিএসএমপি গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতে মোট ৬৭টি সোলার পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে সরকার। গ্রিড সংযুক্ত সোলার পার্ক থেকে চার হাজার ১৫.৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৩৬ মেগাওয়াট সক্ষমতার ১১টি সোলার পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।

প্রথম পর্বের অবস্থা যখন এই, সেখানে নতুন করে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ২০৩০ সালের মধ্যে মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস ও ক্লিন এনার্জি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে জমির প্রয়োজন হয় তিন একর। সেই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সময়োপযোগী বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনাও দরকার। তিনফসলি জমিতে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো ধরনের প্রকল্পই করা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। মূলত জমিস্বল্পতার কারণেই প্রথম দফার লক্ষ্য পূরণ হয়নি।

পাওয়ার সেলের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ)। পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানির সক্ষমতা তৈরি হয়েছে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) গত ৬ মের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা মোট এক হাজার ৩০৩.২৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে শুধু সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা এক হাজার ৬৯.২৭ মেগাওয়াট।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d