দেশে ১০ লক্ষাধিক পথশিশু!
৯৫ শতাংশই শিক্ষা গ্রহণ করছে না, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ, দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা করে ওরা
দেশে বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দেশের রাজনৈতিক দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি—এসব নানাবিধ কারণে বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। এই পথশিশুদের সম্পদে পরিণত করতে হবে, নইলে এই শিশুরাই একসময় সমাজের জন্য হুমকি হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর সংসদ ভবনের সিগন্যালে কথা হয় রাজিবের সঙ্গে। কিছু ফুল বিক্রি করছিল শিশুটি। বয়স আনুমানিক ১২ বছর। সে জানায়, বাবা-মা থাকলেও তারা অন্যত্র বিয়ে করে তাকে ফেলে চলে গেছেন। দাদির কাছে বড় হয়েছে, সেখান থেকে সম্প্রতি গ্রামের এক লোক মিরপুরে একটি দোকানে কাজে দিয়েছিল, সেখানে মালিকের নির্যাতনের কারণে রাজিব পালিয়ে এসে পথে উঠেছে। এখন পথই তার ঘরবাড়ি। ফুল বিক্রি করে কখনো খায়, কখনো ভিক্ষা করে। এভাবেই অনাহার-অর্ধাহারে চলছে তার পথের জীবন।
ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শীর্ষক জরিপ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। জরিপে রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে। ‘গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি’র ২০২২ সালে ঢাকা ও বরিশালের মধ্যে চালানো জরিপের তথ্যে জানা গেছে—পথশিশুদের ওপর সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ। ৭৯ শতাংশ পথশিশু জীবনের কোনো একপর্যায়ে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। পিতৃপরিচয় না থাকায় ৭৬ শতাংশ পথশিশুকে মানসিক নিপীড়ন, হেনস্তা, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শোনাসহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তির শিকার হতে হয়। তাছাড়া শুধু শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ পথশিশু। দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা করে একটি পথশিশু। ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের শিক্ষাগ্রহণ করছে না। ৩৫ শতাংশ শিশু ভিক্ষা করার কথা স্বীকার করেছে। ৪২ শতাংশ শিশু রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত পথশিশু জরিপ ২০২২-এর ফলাফল অনুযায়ী, প্রধানত ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু দারিদ্র্য, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা-মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছে। প্রতি পথশিশুর পাঁচ জনের দুই জনই একা একা শহরে এসেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাস্তায় দেখা যায় ছোট ছোট মেয়েগুলো থাকছে, এদের কী ভবিষ্যত্ আছে? এরকম দুঃসহ জীবন তো আমরা চিন্তা করতে পারি না। এদের কোনো আইডি কার্ড নেই। এদের একটা আইডি কার্ড করার জন্য আমরা চিন্তাভাবনা করেছিলাম। শিশুরা এ অবস্থায় থাকা জাতির জন্য রীতিমতো ভয়ংকর একটা বিষয়। এটা সমাজের মানুষের দায়িত্বহীনতা যে তাদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, স্বাভাবিক কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। বয়স যত কম হবে তার ঘুমের তত বেশি প্রয়োজন। পথশিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
‘ভালো কাজের হোটেলে’র প্রধান উদ্যোক্তা ও পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, পথশিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নৈতিক শিক্ষাও পায় না। যে কারণে কোনটা ন্যায় বা অন্যায় তারা বুঝতে পারে না। তাই পথশিশুদের হাতে ১০ টাকা ২০ টাকা দিয়ে নানা খারাপ কাজ করানো হয়। তিনি বলেন, ‘পথশিশুরা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে, মাদক ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। তারা ছিনতাই করছে। তাদের জন্য সাসটেইনেবল পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা চাইলে তাদের সম্পদে পরিণত করতে পারি। আর তা না করতে পারলে ঐ শিশুরা আমাদের সমাজের জন্য হুমকি হবে।’