দেশ চলবে জামায়াতের চেতনায়? ইতিহাসের সাক্ষী হবে ‘লন্ডন সংলাপ’

‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতে ইসলামীও তেমনি ইসলাম নয়’ -মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বহু বছর আগে মজলুম জননেতার জামায়াতকে নিয়ে মূল্যায়ন এখনো মানুষ স্মরণ করছে। আর কয়েক মাস আগে আমিরে হেফাজত আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে ইসলামী দল বলে মনে করি না।’ ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে ঢাকা ও করাচির প্রেক্ষাগৃহে। শাবানা, জাফর ইকবাল অভিনীত ছবিটির নামকরণ ৫৫ বছর পরও কি জামায়াতের উপর ভর করেছে? গত ১৩ জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়েছে। ‘ইতিহাসের সাক্ষী’ সেই বৈঠকের দিকে গোটা জাতি তাকিয়ে ছিল। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হলো- আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে, দুই নেতাই রমজানের আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। এ বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক হানাহানির হাত থেকে বাঁচল জাতি। সবাই খুশি, ভোট দিতে মুখিয়ে। অন্যান্য দলের মতোই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রতিক্রিয়া জানালেন, “লন্ডনের বহুল আলোচিত বৈঠক জনআকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ইতিবাচক মনে করছে জামায়াত। জামায়াত বৈঠককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে।’ কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলটি ‘ইতিবাচক’ বৈঠককে ‘নেতিবাচক’ অভিহিত করে! দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠক পর জানানো হয়- ‘জামায়াত লন্ডন বৈঠককে স্বাভাবিক মনে করলেও যৌথ ব্রিফিংকে ‘ভালোভাবে’ নেয়নি। এতে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ করেছে।”
জামায়াতের এই ভোল পাল্টানো বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের ঝড় বইছে। জামায়াত অনুগত নেটিজেনরা ড. ইউনূস ও বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালেও সাধারণ নেটিজেনরা বলছেন, জামায়াত রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে- এটা ভালো। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দলটির চেতনায় দেশ চলবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মর্ডান ইসলামী দল’ সার্টিফিকেট পাওয়া জামায়াত দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ঠিক করে দিতে চায়- এমন প্রশ্ন করেন কেউ কেউ।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের আমির সর্বপ্রথম রমজানের আগে নির্বাচনের দাবি করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির দাবি ছিল ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে হবে। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বিএনপি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পাবলিক পরীক্ষা, গরম ও রমজানে প্রচারণার অসুবিধা জানিয়ে ডিসেম্বরে অনড় থাকলেও জামায়াত এপ্রিলে নির্বাচন দাবি করে। প্রধান উপদেষ্টা ঈদের আগের দিন ভাষণে এপ্রিলে নির্বাচন হবে- এমন ঘোষণা দেয়ার পর বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে। সঙ্কট নিরসনে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে কিছু সংস্কার ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেব্রæয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। প্রথমে জামায়াত সেটিকে ইতিবাচক মনে করলেও পরের দিন নেতিবাচক প্রচার করে। প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতের এই স্ববিরোধী অবস্থানের নেপথ্যের রহস্য কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রহস্য হচ্ছেÑ ভ্রান্তিবিলাস। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালানোর পর নিষিদ্ধতা উঠে যাওয়ায় হঠাৎ করে জামায়াতের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দলটির নেতাকর্মী-সমর্থক ইউটিউবার-কনটেইন ক্রিয়েটররা ব্যাপক প্রচারণায় চালানোয় দলটি ধরে নেয়, রাজনৈতিক শক্তি ও জনসমর্থনে তারাও বিএনপির সমপর্যায়ে চলে এসেছে। এ কারণে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে বিএনপিকে পরাভ‚ত করতে দলটির নেতারা মরিয়া হয়ে উঠেন। যার কারণে দলটির আমির ‘আমরা ভারতবিরোধী নই’, ‘জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীরা পছন্দমতো পোশাক পরে রাস্তায় নামতে পারবে’ ‘ফ্যাসিস্ট শব্দ বারবার বলতে ভালো লাগে না’ ‘আওয়ামী লীগকে মাফ করে দিয়েছে জামায়াত’ বক্তব্য দেন। শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে দলটি হিন্দুধর্মীয় শাখা খোলে এবং দলটির আমিরের মালিকানাধীন সিলেটের মহিলা মেডিক্যাল কলেজের সাড়ে ১২শ’ ডাক্তার-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আড়াইশ’ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এমন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়া হয়। পলাতক আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী ও ভোটারদের ভোট জামায়াতের পক্ষে নিতে গ্রামে গ্রামে মসজিদকেন্দ্রিক বিশেষ কার্যক্রম শুরু করে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জামায়াতের বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ণ করতে গিয়ে বলেন, ‘জঙ্গলে ব্যাঙ যেমন হাতিকে দেখে নিজেকে হাতির চেয়ে বড় প্রমাণে পেট ফুলাতে থাকে; জামায়াতের অবস্থা হয়েছে ওই ব্যাঙের মতোই। আওয়ামী লীগ দিল্লির নীলনকশায় ১৫ বছর জামায়াতের উপর সুনামি চালালেও পর্দার আড়ালে আওয়ামী লীগ-জামায়াত সমর্থকদের ব্যবসা-বাণিজ্য একসঙ্গে চলেছে। এমনকি শিবিরের ছেলেরা আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন-ছাত্রলীগের ভেতরে গিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পর্দার আড়ালের সেই রহস্য প্রকাশ করা হয়।
১৯৪১ সালে জন্ম নেয়া জামায়াত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কখনোই জনসমর্থন পায়নি, রাজনীতির মাঠে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি। সাধারণ মুসলমানরা দলটিকে নিজেদের দল হিসেবে মেনে নেয়নি। পাকিস্তান আমলে দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে পাকিস্তান থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর দলটি নিষিদ্ধ পরবর্তীতে দলটি পুনর্জন্মের পরও গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। বিএনপি ও জামায়াত দীর্ঘ দুই দশক শরিক দল হিসেবে পরিচিতি পেলেও স্বার্থের খাতিরে আওয়ামী লীগ আর জামায়াত যেন জমজ ভাই। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে শেখ হাসিনার ‘এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় বেঈমান হবে’ ঘোষণার পর জামায়াত ও আওয়ামী লীগ মিলে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। ওই সময় জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ-জামায়াত আসন সমঝোতায় নির্বাচনে জামায়াত ১০টি আসন পায়। অতঃপর এরশাদ পতনের পর বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮টি আসন পায়। বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ-জামায়াত জোট আন্দোলনের পর ’৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি পায় তিনটি আসন। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে পায় ১৭ আসন। অতঃপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে পায় দুটি আসন। ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলামী ধারার দলটির এই যখন চিত্র, তখন দলটি বিএনপির মতো দলকে টেক্কা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা পালানোর পর সাংগঠনিক পর্যায়ে জামায়াতের ‘আলাদিনের চেরাগ’ পাওয়ার অবস্থা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। শত শত ইউটিউবার, কনটেইন ক্রিয়েটর, অনুগত সাংবাদিক, শিবিরের উচ্চশিক্ষিত নেতাকর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা প্রতিদিন জামায়াতের পক্ষে জনমত গঠন এবং বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এমনকি মাওলানা আমির হামজা, মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারিসহ শত শত ইসলামী বক্তাকে মাঠে নামানো হয়েছে। তারা ইসলামী জলসা এবং ওয়াজ মাহফিলের নামে জামায়াতের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং বিএনপির বিরুদ্ধে বিয়োদগার করছেন। কিছু কিছু ভ‚ঁইফোড় প্রতিষ্ঠান জনসমর্থনের জরিপ করে জনসমর্থনে কেউ বিএনপির চেয়ে জামায়াতে এগিয়ে রয়েছে প্রচার করছেন; কেউ বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থন সমানে সমান প্রচার করছেন। এ প্রেক্ষাপটে দেশ-বিদেশের কিছু গণমাধ্যম সাংগঠনিক এমনকি জনসমর্থনের দিক দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতকে সমপর্যায়ের উল্লেখ করে খবর-নিউজ প্রচার করছে। এ চিত্রে দেখে জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা কার্যত ব্যাঙের মতোই ভ্রান্তিবিলাসে পড়ে গেছেন। অথচ গত বছরের ডিসেম্বরে ইনকিলাবের এক জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচন হলে বিএনপিকে ৬১.০৮ শতাংশ এবং জামায়াতকে ১৪.৮২ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পারেন বলে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।
অপ্রিয় হলেও প্রমাণিত সত্য যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মুরব্বি হিসেবে হিন্দুত্ববাদী ভারত ১৫ বছর নীলনকশা করে দলটিকে ক্ষমতায় রেখেছিল। হাসিনা পালানোর পরও দিল্লি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী ‘জামায়াতে ইসলামী প্রকৃত ইসলামী নয়’ উক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্র সবসময় জামায়াতকে মডারেট ইসলামী দল মনে করে। বিগত কয়েক বছর মৌলবাদী ও জঙ্গি ইস্যুতে বিতর্ক হলেও যুক্তরাষ্ট্র সবসময় জামায়াতকে মডারেট ইসলামী দল হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছে। হাসিনা পালানোর পর এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সেই অবস্থান রয়ে গেছে। ফলে অন্যান্যরা মৌলবাদের উত্থান নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলেও জামায়াতের প্রতি মার্কিনিদের পক্ষপাতিত্ব রয়ে গেছে। সেটি দলটির জন্য কাজে লাগছে। এ ছাড়াও দলটি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে নিজেদের ‘মডারেট ইসলামী দল’ প্রমাণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জামায়াতের নতুন উত্থান ঘটে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। অবশ্য অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের নতুন দল এনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যসহ কোটি কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি হাসিনার অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠে। কিছু কিছু অভিযোগ এনসিপির নেতারা স্বীকার করেছেন, কিছু কিছু অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে যে ছাত্রনেতারা মাসে তিন হাজার টাকা খাওয়ার খরচ জোগাতে পারতেন না তারা এখন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার গাড়িতে চড়েন। এক বছর আগেও হোস্টেলে ও মেসে থাকতেন তারা এখন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠায় সারা দেশের বিএনপির প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তারেক রহমান। কিন্তু এনসিপির দু’-চাজন নেতাকে গ্রেফতার করা হলেও অন্যরা এখনো নির্বিঘ্নে রয়েছেন। বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগগুলো জামায়াত সমর্থিত মাওলানারা ওয়াজ মাহফিলে প্রচার করছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে, প্রশাসনকে কবজা করছে জামায়াত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতি চেতনাধারীদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হচ্ছে। ঢাক, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত অনুসারীদের ভিসি, রেজিস্ট্রারসহ গুরুত্বপর্ণ পদে বসানো হয়েছে। সচিব থেকে শুরু করে ডিসি পর্যন্ত জামায়াত অনুসারীদের পদায়ন ও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এমনকি আমলাদের যারা এতদিন হাসিনার অলিগার্ক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন; তাদের অনেকেই এখন নিজেদের জামায়াত অনুসারী প্রমাণের চেষ্টা করছেন। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো প্রচারণা নেই। আবার অভ্যুত্থানের পর ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগের গোপন আঁতাত ফাঁস হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কমিটি ঘোষণার পর দেখা গেল, শিবিরের নেতারা এতদিন ছাত্রলীগের পেটের ভেতরে থেকে রাজনীতি করেছেন। বছরের পর বছর ধরে শিবির নেতারা ছাত্রলীগের শেল্টারে থেকেছেন। নতুন কমিটি ঘোষণার পর নিজেরাই সেটি প্রকাশ করেছেন। ভারতের পানি আগ্রাসন নিয়ে প্রতিবাদ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ায় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগ পিটিয়ে হত্যা করে। পৈশাচিক ওই হত্যাকান্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় হলে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে কয়েক জনের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি ছাত্রলীগ নেতা মেহেদি হাসান রাশেল, মেহেদী হাসান রবিন, অমিয় সাহাসহ সাতজন মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে হাইকোর্টে আইনি সহায়তা দেন জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট শিশির মনির। এ নিয়ে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা তরুণ রাজনীতিক ও ইউটিউবার তারেক রহমান বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ভেতরে যে নেতারা শিবির ছিলেন তাদের পক্ষে হাইকোর্টে আইনি সহায়তা দিয়েছেন জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট শিশির মনির। জামায়াতের এই আইনজীবী আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ১০০ নেতার পক্ষে আইনি লড়াই করেছেন।’ এ ঘটনায় পরিষ্কার, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছাত্রলীগ পুনর্বাসন করেছিল শিবিরকে। সে সময় বিএনপির বিরুদ্ধে সরকার কঠোরতার মধ্যে কৌশলে জামায়াতের ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি যেগুলো করেছে সেগুলোতে শিবিরের লোকজনও ছিল।
১৩ জুন ড. ইউনূস-তারেক বৈঠক নিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বৈঠক নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ওই বৈঠকে দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এ বৈঠকের সঙ্গে দেশের মাটি ও মানুষের কোনো সংযোগ নেই। সংস্কার আর বিচারকে পাশ কাটিয়ে সরকার যে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে তা ১৮ কোটি মানুষের নির্বাচন হবে না। একটি রাজনৈতিক দলকে খুশি করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আনা হচ্ছে, যা জুলাইয়ের শহীদদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। বাস্তবতা হচ্ছেÑ জামায়াতের মতোই অবস্থা এনসিপি। ‘নতুন বন্দোবস্ত’ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে দল গঠন করলেও এনসিপি সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারেনি। দলটির কর্মকাÐ এখনো সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও সভা-সমাবেশে এখনো জামায়াত-শিবিরের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নামে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাম দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতা থাকলেও শিবিরের আধিক্য বেশি ছিল। বিশেষ করে ছাত্রলীগের পেটের ভেতরে যেসব শিবির নেতা বছরের পর বছর লুকিয়ে ছিলেন তারা কোটা আন্দোলনে সক্রিয় হন। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সমর্থন ছাড়া তাদের পক্ষে এত বড় ছাত্র আন্দোলন সম্ভব ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, এনসিপির যেসব কর্মসূচিতে জামায়াত শিবির অংশ নিচ্ছে সেসব কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম হলেও যেগুলো এনসিপিকে একাই করতে হচ্ছে, সেগুলোতে লোকসমাগম হচ্ছে না।
লন্ডন বৈঠক নিয়ে জামায়াত ও এনসিপির বক্তব্য প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘লন্ডন বৈঠকে কে বিজয়ী হয়েছে তা বলার আগে বলতে হচ্ছে- জামায়াত ও এনসিপির পরাজয় ঘটেছে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে জামায়াতের জন্য খুবই ক্ষতি। কারণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্য তারা নিন্দিত হয়ে থাকে। এখন তাদের চিন্তা-চেতনা দেশের মানুষ মেনে নেবে না। জামায়াতের চেতনায় দেশ চলতে পারে না।’ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, লন্ডন বৈঠক নিয়ে জামায়াতের অবস্থান স্ববিরোধী বলে মনে হচ্ছে। দলের সেক্রেটারি প্রথম এ বৈঠককে সাধুবাদ জানিয়েছেন, পরদিন আবার দলের পক্ষ থেকে বৈঠকের নানান সমালোচনা করেছেন। আসলে রোজার আগে নির্বাচন হলে ভালো- এমনটি জামায়াতের আমির প্রথম বলেছিলেন। এপ্রিলে নির্বাচনের জন্য ভালো সময় নয়, এটি সব দলেরই অভিমত। এখন জামায়াত যেটি বলছে এটি হয়তো একান্তই তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য। এটি থাকতেই পারে। সব দল সব কিছুতে একমত হবে- এমনটি ভাবা ঠিক নয়। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, লন্ডন বৈঠকটি দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। জামায়াত তাদের দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিচার বিশ্লেষণ করছে। তারা প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলেছে, এমন অভিযোগ এ সরকারের বিরুদ্ধে আরো আগেও উঠেছে। তাই সরকারের উচিত তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এমন কিছু না করা। তবে জামায়াতের অভিযোগ অবান্তর। আর নির্বাচনের বিষয়ে যে সমঝোতা হয়েছে তার আলোকে এখন সব দলের সাথে আলোচনা করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা উচিত। শুধু জামায়াত বা অন্য দল যা বলল, সে মতে কাজ করলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আরো প্রশ্ন উঠবে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত।