Bangladesh

দেশ টিভি’র আরিফ হাসান জব্দ ৩শ’ ৪১ কোটি

শত শত কোটি টাকা পাচার দায়মুক্তিতেও ঢালছেন অর্থ

কাগুজে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে গত এক দশকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লুট করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের হাত করে লুটেরা শ্রেণি লুণ্ঠিত অর্থ সরিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। দেশের ভেতরও করেছেন বিপুল বেনামী সম্পদ। বড় দাগের এই লুন্ঠনকারীদের অধিকাংশই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অনেকে থেকে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। কেউ কেউ নিজেই সংবাদ মাধ্যমের মালিকানা কিনে এড়িয়েছেন সমালোচনা। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অর্গানকে কাজে লাগিয়ে কোথাও কোথাও চেষ্টা করেছেন পিঠ বাঁচানোর। তা সত্ত্বেও রেহাই মেলেনি কারও কারও। এমনই এক অর্থপাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা, কথিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘হাসান টেলিকম বিডি’। মালিক আরিফ হাসান। যেনতেন ভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়াই ছিলো যার নেশা। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)র প্রতিবেদন উঠে আসে আরিফ হাসানের সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেন এবং অর্থ পাচারের তথ্য। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু সেই অনুসন্ধান পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করেন আরিফ। বিপুল অর্থ ঢেলে চেষ্টা চালাচ্ছেন অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি লাভের। চেষ্টা চালাচ্ছেন জব্দকৃত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আরও অর্থ সরিয়ে নেয়ার। যদিও গত ১২ জুলাই আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট তার ১৫টি অ্যাকাউন্টই জব্দ রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অ্যাকাউন্টগুলোতে ৩শ’ ৪১ কোটি ১লাখ ২১ হাজার ৭৪২ টাকা রয়েছে। দুদকের আবেদনে ২০২০ সালে অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজের নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকার মহানগর বিশেষ জজ আদালত।

আদালত এবং দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেতে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেছেন হাসান টেলিকম’র মালিক আরিফ হাসান। আশ্রয় নিয়েছেন নানা কূটকৌশলের। এ লক্ষ্যে ‘তদবিরকারক’ নিয়োগের পাশাপাশি আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীর ল’ চেম্বারের এক নারী আইনজীবীকে। তবে ওই আইনজীবী তারপক্ষে আইনি লড়াই করলেও দুদক থেকে দায়মুক্তির কোনো নিশ্চয়তা দেননি বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আরিফ হাসান কথিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘হাসান টেলিকম বিডি’র মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পেন্টা এ ধারায় মাশুল গুণে আয়কর নথিতে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত অর্থ ‘বৈধ’ করেন। কিন্তু রাজস্ব আইন, দুদক আইন এবং অর্থ পাচার আইন আলাদা। ফলে কালো টাকা সাদা করেও শেষরক্ষা হয়নি। অবৈধ সম্পদের মালিকানার অকাট্য দলিল হয়ে দাঁড়ায় তার দাখিলকৃত আয়কর নথি। আয়কর নথিই এখন দুদকে সাক্ষ্য দিচ্ছে আরিফ হাসানের বিরুদ্ধে। ভেবেছিলেন, দুদকে ট্যাক্স ফাইল দাখিল করলে তাকে দায়মুক্তি দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক দৌড়-ঝাঁপও করেন। ঢালেন বিপুল অর্থ। কিন্তু অবৈধ অর্থ এবং সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণাদি এতোই অকাট্য যে, তাকে দায়মুক্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদলাতে সমর্থ হয়েছেন। আরিফ হাসানের বিরুদ্ধে ১শ’ ২৮ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান এখনও চলমান। মহাপরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত)র তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ টিম অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।

দুদক টিমের হস্তগত সন্দেহজনক লেনদেনের রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, কথিত ব্যবসায়ী আরিফ হাসান ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর সাউথইস্ট ব্যাংকের মৌচাক শাখায় ( হিসাব নং ০০৪৫-১২১০০০০০১৬২) ১৮টি অ্যাকাউন্টে ৬ কোটি ৫০লাখ টাকা ডিপোজিট করেছেন। এই অ্যাকাউন্ট থেকে একই দিন উত্তোলন করেছেন ৭ সকোটি টাকা । ওই বছর ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টে জমা ছিলো ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৮ টাকা । এই অর্থের কোনো উৎস নেই। সাউথইষ্ট ব্যাংকের মৌচাক শাখার ‘হাসান টেলিকম’র সেভিংস অ্যাকাউন্টে (হিসাব নং ০০৪৫ ১১১০০০০০৭৫৩) ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের ৮টি অ্যাকাউন্টের ৩৭ কোটি টাকা জমা হয়। একই দিন পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা তোলা হয়। অনুসন্ধান টিম এটিকে ‘সন্দেহজনক লেনদেন’ হিসেবে শনাক্ত করে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাসান টেলিকম লিমিটেড একটি কোম্পানি। এটির ১০ হাজার শেয়ার রয়েছে। আরিফ হাসানের নামে ৮ হাজার শেয়ার ও মোহাম্মদ আলমগীর নামের অপর একজনের নামে ২ হাজার শেয়ার রয়েছে এই কোম্পানির। জয়েন্টস্টকে নিবন্ধিত কোম্পানির নথি অনুযায়ী, আরিফ হাসান ও তার পিতা আব্দুল আজিজের নামে গুলশানের ১১৮ নং রোডে (বাড়ি নং ৪) রয়েছে ৪৬ লাখ টাকার মূল্যের একটি ফ্ল্যাট। বসুন্ধরায় জমি ক্রয়ে বিনিয়োগ দেড় কোটি টাকা, দেশ টিভির শেয়ারে বিনিয়োগ ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা, দেশ এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ ৮ লাখ টাকা, হাসান টেলিকমের বিনিয়োগ ৮ লাখ। ৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র এবং বিভিন্ন ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব, এফডিআর ও নগদসহ মোট ১২০ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৮ টাকা।

এর আগেও একাধিকবার আরিফ হাসানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ জমা পড়ে। কিন্তু মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তিনি অন্তত: তিনবার অনুসন্ধান নথিভুক্তির সুপারিশ করান। ২০১৬ সালে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দুদক উপ-পরিচালক নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল ৩ দফায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেয়। ২০২০ সালের প্রথম দিকে অভিযোগটি পরিসমাপ্তির (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) সুপারিশ দেয়া হলেও কমিশন সেটি অনুমোদন করেনি। পরবর্তীতে ওই বছর মার্চ মাসে দুদকের তৎকালিন পরিচালক (বর্তমানে মহাপরিচালক) সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয় পুন:অনুসন্ধানার্থে। ২০২১ সালেও আরেক দফায় টিম পুনর্গঠন করা হয়।

তবে এ অনুসন্ধানের মধ্যেই আরিফ হাসানের কাগুজে প্রতিষ্ঠান ‘হাসান টেলিকম’ ব্যবহৃত হয় অবৈধ অর্থ লেনদেনে। ২০১৮ সালের শেষ দিকের ঘটনা। গ্রাহকের আস্থা হারানো ‘ন্যাশনাল ব্যাংক’র পরিচালকগণ আরিফের ‘হাসান টেলিকম’র নামে কয়েক দফায় ৩শ’ ৮৫ কোটি টাকা ঋণ সৃষ্টি করে। ভুয়া কার্যাদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ ঋণের আড়ালে ৩৩৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেয় আরিফ হাসান, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনাপর্ষদ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। অবশিস্ট ১৫০ কোটি টাকাও তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

বিএফআইইউ) প্রতিবেদনে জানায়, হাসান টেলিকমকে দেওয়া ঋণের ৬৪ কোটি টাকা সরাসরি জমা হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রিক হক সিকদার, সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলাম ( মোহন) এবং সিকদার গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার প্যাক’ ও ‘সিকদার রিয়েল এস্টেট’র অ্যাকাউন্টে।
২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর প্রথম দফায় হাসান টেলিকমের নামে ১শ’ কোটি টাকা ছাড় করে ব্যাংক। সেদিনই ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রিক হক সিকদারের অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলামের অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। গ্রুপটির মালিকানাধীন পাওয়ার প্যাকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয় ১০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ দিয়ে আরিফ হাসান নিজের নামে ন্যাশনাল ব্যাংকে বিভিন্ন মেয়াদের ডিপোজিট করেন।

একই বছর ২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় আরও ১০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। এর মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রিক হক সিকদারের পশ্চিম ধানমন্ডি শাখার হিসাবে জমা হয় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১০ ডিসেম্বর সিকদার রিয়েল এস্টেটের হিসাবে জমা হয় ২০ কোটি টাকা। বাকি টাকা আবারও আরিফ হাসানের বিভিন্ন হিসাবে জমা হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আরও ৬০ কোটি টাকা ছাড় করে ব্যাংক। এ টাকা নগদে উত্তোলন করেন আরিফ হাসান।

এর আগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির শীর্ষ দুই খেলাপি গ্রাহক ‘ইপসু ট্রেডিং’ ও ‘ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল’। এর মধ্যে ইপসুর কাছে পাওনা ছিল ১৪৫ কোটি টাকা এবং ক্যামব্রিজের কাছে ১৩৫ কোটি টাকা। এসব ঋণ বিতরণ হয়েছিল ২০১৩ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালেই এসব ঋণ মঞ্জুরের অনিয়ম, ব্যবহার ও সুবিধাভোগী নিয়ে প্রশ্ন ওঠায়। ব্যাংকটির নিমতলী শাখায় ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ইপসু ট্রেডিংয়ের নামে অ্যাকাউন্ট খোলার দুই দিন পরই ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হয়। এ অর্থ দিয়ে সিকদার রিয়েল এস্টেটের জেড এইচ সিকদার শপিং কমপ্লেক্স’র স্পেস কেনেন। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলী বাজারের এ শপিং কমপ্লেক্সের প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম ১২ হাজার ৮২০ টাকা ধরা হয়। যা বাজারমূল্য অনুযায়ী কয়েকগুণ বেশি ছিল।

ব্যাংকের সীমান্ত স্কয়ার শাখায় ২০১৩ সালের ১৩ মে ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনালের হিসাব খুলেই ভবন ক্রয়ের জন্য ১৩২ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। পরদিন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সভায় তা অনুমোদনও দেয়া হয়। এরপর ভবনবিক্রেতা ও ব্যাংকের পরিচালক মনোয়ারা সিকদারের অনুকূলে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই বছরের ২২ মে ৫৫ কোটি, ২৭ মে ৫৫ কোটি এবং ২৮ মে ৪১ কোটি টাকা ছাড় করা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d