Bangladesh

দ্রুত নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছে সরকার

দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, কবে সে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা, সন্দেহ ও শঙ্কার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচন একটি জাতির গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। যত দ্রুত সম্ভব, এ বছরের শেষ দিকে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে পারে।’ জাপানের সরকারি টেলিভিশন এনএইচকেকে গত বুধবার দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

এর আগে গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময় তুলে ধরেন।

তিনি চলতি বছরের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেন। পরদিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর নির্বাচন কমিশন জানায়, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে কমিশন।

প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকার যখন চাইবে তখনই নির্বাচন করতে প্রস্তুত ইসি।’

কিন্তু এনএইচকেকে দেওয়া গত বুধবারের ওই সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ‘২০২৬ সালের প্রথমার্ধ’—এই বর্ধিত সময়সীমা থেকে সরে এসেছেন বলে অনেকের ধারণা। যদিও একই দিনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন এ বছরের শেষ নাগাদ, নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে তা নির্ভর করছে জুলাই চার্টারের ওপর।’ জুলাই চার্টার হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশনের গ্রহণযোগ্য সুপারিশগুলো সম্পর্কে ‘ঐকমত্য কমিশন’-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়া। কিন্তু এ কাজটি সম্পন্ন করার সময়সীমাও নির্ধারিত নেই।

প্রধান উপদেষ্টার ওই সাক্ষাৎকারের দিন রাতেই দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধ আচরণের ঘটনা ঘটে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও তাঁর দোসরদের উসকানিমূলক আচরণ, জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান সম্পর্কে অশালীন ও আপত্তিকর বক্তব্য, মন্তব্য দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধের জন্ম দেয়। এরই ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত স্বৈরাচারের স্মৃতি, মূর্তি, স্থাপনা ও নামফলকগুলো ভেঙে ফেলার মতো জনস্পৃহা দৃশ্যমান হয়।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত ছয় মাসেও পলাতক স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ জনসমক্ষে দৃশ্যমান করতে সফল হয়নি বলে জনমনে প্রতিভাত হয়েছে। ফলে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হচ্ছে। একটি সরকার বহাল থাকা অবস্থায় জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।’

বিএনপির ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘জুলাই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত শিগগির সম্ভব একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। নির্বাচনমুখী জরুরি সংস্কার সাধন করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করাই বর্তমান সরকারের প্রধানতম ম্যান্ডেট। অথচ জন-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই এই অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্যান্য বিষয়ে অধিক মনোযোগী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’

এদিকে এনএইচকেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নির্বাচিত নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য নিরাপদ ও সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি থাকবে।’

নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরের দিকেই হতে পারে—এমন একটি ধারণা পাওয়া যায় গত বছর সেপ্টেম্বরে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশিত কাজ সম্পন্ন হবে কি না, সে প্রশ্ন ওঠে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে দ্রুত নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের ঘটনা ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগেই জানিয়েছিল, তারা রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচন চায়। কিন্তু বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো ক্রমেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জোরদার করে।

নির্বাচন হবে এবং দেশ কোন পথে যাচ্ছে তা নিয়ে জনসাধারণ অন্ধকারে বলেই মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। গতকাল তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমরা এই সময় নির্বাচন ‘হতে পারে’ বলে শুনছি। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা এখনো জানানো হয়নি। সংস্কার কী হবে, কতটুকু, কেমন হবে তা-ও জানি না। যত সময় গড়াবে দেশি-বিদেশি অপতৎপরতায় দেশের সংকট আরো বাড়বে।” 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার বিকেলে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সোনাগাজী ছাবের সরকারি পাইলট হাই স্কুলে মাঠে দলের এক সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, ‘সংস্কার সংস্কার কথা বলে সংস্কারের কাজ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এটি কোনো ষড়যন্ত্র কি না, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। সংস্কার দীর্ঘায়িত হলে সমস্যা বাড়বে। আইনের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। দ্রুতগতিতে সংস্কার শেষ করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

‘নির্বাচনের আগে সংস্কার’কে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া জামায়াতে ইসলামীও বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে শুরু করেছে। এই দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘দলীয় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমাদের দল যোগ্য প্রার্থী বের করতে একটি বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তবে কেন্দ্র থেকে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করিনি।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে। তাঁরা এ মাসেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। দলের নাম এখনো চূড়ান্ত না হলেও দলের নেতৃত্বে কারা আসছেন তা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এই দলের আহ্বায়ক হচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র আভাস দিয়েছে। সদস্যসচিব এবং অন্যান্য শীর্ষ পদে কারা থাকবেন তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।

আইন সংস্কারের অপেক্ষায় নির্বাচন কমিশন : জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা ছাড়াও নির্বাচনী আসনগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার বিধান রয়েছে। এ জন্য নীতিমালা প্রস্তুত ও গেজেট প্রকাশ, জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পুনর্নির্ধারিত সীমানার খসড়া তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করে দাবি, আপত্তি ও সুপারিশ আহ্বান এবং শুনানি শেষে নিষ্পত্তি করা ও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এ কাজে প্রায় ছয় মাস সময় নিয়েছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে ১৩০ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল এবং তা আজও বহাল আছে। ওই সময় যে আসনগুলোয় বিএনপির জনপ্রিয়তা ছিল সেগুলো কর্তন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে এবার সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং বিদ্যমান নিবন্ধিত দলের বর্তমান অবস্থা পরীক্ষা করে দেখাও নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কাজ। আগের নির্বাচন কমিশন এই কাজে প্রায় আট মাস সময় নিয়েছিল।

এসব কাজ সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন গত বুধবার কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সংস্কারের সুপারিশগুলো এখনো না পাওয়ায় আমাদের অনেক কাজই শুরু হয়নি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে এখনো পাঁচ-ছয় মাস লাগতে পারে। অন্যদিকে ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে অক্টোবরের মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। তফসিলের আগে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, নতুন দলের নিবন্ধন ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ ছাড়াও পর্যবেক্ষক নীতিমালা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী মালপত্র ক্রয়—এসব করতে নির্বাচন কমিশনের অনেক সময় প্রয়োজন। কিন্তু নির্বাচন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যোগাযোগ, সহযোগিতায় এখনো গতি নেই।

ফ্যাসিস্টদের বিচার এখনো অসম্পন্ন : আগে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিচার, তারপর নির্বাচন—এই দাবি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের। এই বিচারের ওপর নির্ভর করছে আসন্ন নির্বাচনে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দলের নেতারা অংশ নিতে পারবেন কি না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগও নির্বাচনে যোগ্য থাকবে কি না সে প্রশ্নেরও মীমাংসা প্রয়োজন। সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একাধিকবার বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের মাধ্যমেই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা ও আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছরের গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালে মামলা (মিসকেস) হয়েছে ১৬টি। এতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ ১০৮ জনকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখনো এসব মামলার একটি তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়নি। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor