Bangladesh

নজরদারিতে আসছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন

দেশে কার্যরত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমে আরও শৃঙ্খলা আনতে একটি নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার, যে আইনে সংগঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদ, নির্বাহী পরিষদের সদস্য বা অন্য কোনো সদস্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশবিরোধী নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হতে পারবে না। জনগণের স্বার্থবিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী, দেশের সংবিধান বা প্রচলিত আইন পরিপন্থি কোনো কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংস্থাটির নিবন্ধন বাতিল হবে। ‘স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা নিবন্ধন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ শিরোনামে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় এসব ধারা যুক্ত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও নিবন্ধনের জন্য ১৯৬১ সালের একটি অধ্যাদেশ আছে। ওই অধ্যাদেশ দিয়েই বর্তমানে সমাজকল্যাণমূলক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কলেবর ও কার্যপরিধি বেড়েছে। ফলে নিবন্ধন ও মনিটরিংয়ের স্বার্থে পুরনো অধ্যাদেশটির বদলে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানান, ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশের আওতায় দেশের প্রায় ৬৮ হাজার সংস্থার নিবন্ধন রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার নিবন্ধনের জন্য এটিকে একটি ‘ভিত্তি আইন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাতে শুধু তহবিল পরিচালনায় অনিয়ম ও সংগঠনের কার্যাবলি পরিচালনায় কুশাসন পরিলক্ষিত হলে পরিচালকমন্ডলীকে সাময়িক বরখাস্তের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধনের জন্য মিথ্যা তথ্য বা ভুয়া কাগজপত্র জমার জন্য ছয় মাসের কারাদন্ড বা ২ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

প্রস্তাবিত নতুন আইনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি ‘দেশবিরোধী নিষিদ্ধ রাজনৈতিক’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘সংবিধানবিরোধী’ শব্দগুচ্ছ যুক্ত করা হয়েছে। এসব অপরাধে এক বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধানও যুক্ত করা হয়েছে।

পুরনো অধ্যাদেশে শুধু সমাজকল্যাণ বিষয়ক কার্যক্রম যেমন : শিশু কল্যাণ, যুব কল্যাণ, নারী কল্যাণ, শারীরিক ও মানসিক অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, কিশোর অপরাধ, কারামুক্ত কয়েদিদের কল্যাণ, সামাজিক শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, ভিক্ষুক ও দুস্থ কল্যাণ- এ ধরনের ১৫টি কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংগঠনকে নিবন্ধনের আওতায় রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ৩৯ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংগঠনকে এই আইনের আওতায় নিবন্ধনযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়ায় আগের বিষয়গুলো ছাড়াও শিশু ও নারী অধিকার সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী, হিজড়া বেদে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার ও উন্নয়ন, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের উন্নয়ন ও পুনর্বাসন, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের সৃজন বা উন্নয়ন, স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা, মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা পুনর্বাসন, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষক উন্নয়ন, সামাজিক ও জন সংগঠন, ভূমি সংরক্ষণ, মানব পাচার, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, সড়ক ও শিল্প দুর্ঘটনায় আহতদের পুনর্বাসন, ক্ষুধা অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, অভিঘাত সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অবকাঠামো নির্মাণ অ্যাডভোকোসি, দুর্যোগ প্রস্তুতি, বন সংরক্ষণ ছাড়াও আইনগত শিক্ষা ও সহায়তা, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সংবিধান ও আইন স্বীকৃত অধিকারের সংরক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোকে নতুন আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রস্তাবিত খসড়া আইনের আওতায় এমন সব বিষয় রাখা হয়েছে, যারা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় বর্তমানে নিবন্ধিত হচ্ছে। ফলে আইনটি কার্যকর হলে নিবন্ধন নিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর কর্তৃত্বের প্রশ্ন উঠতে পারে। উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনী পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত আইনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার উল্লেখ থাকায় এর নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ কে হবে- তা নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। 

সূত্র জানায়, গত ৩০ আগস্ট খসড়া আইনটি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি সভা হয়। ওই সভায় এ বিষয়গুলো নিয়ে খোদ সরকারি কর্মকর্তারাই প্রশ্ন তুলেছেন। ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব মো. নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, বর্তমানে সরকারের অনেক দফতর এ ধরনের সংস্থাকে নিবন্ধন দিয়ে থাকে। কাজেই যে সব দফতর নিবন্ধন দিয়ে থাকে তাদের সবাইকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. মেহেদী উল সহিদ বলেন, ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশটি অনেক পুরনো। এরপর অনেক নতুন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তৈরি হয়েছে। ফলে এ অধ্যাদেশের তফসিলভুক্ত অনেক কাজের নিবন্ধন নতুন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই এ অধ্যাদেশের (প্রস্তাবিত আইন) আওতায় নিবন্ধন নিলে অন্য দফতরের আওতায় নিবন্ধন নেওয়া প্রয়োজন হবে কি না এবং বিষয়গুলো কীভাবে মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করা হবে-তা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান এস এম ফজলুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত আইন চালু হলে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর নিবন্ধন, ব্যবস্থাপনা ও কার্যপরিচালনার জন্য অন্যান্য নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠান, যেমন কোম্পানি আইন, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর, সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, সমবায় অধিদফতর, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি থেকে নিবন্ধন গ্রহণ প্রয়োজন হবে কি না এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button