নড়বড়ে নিরাপত্তা, বেড়েছে অপরাধ
ছাপান্ন সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। এতে দেখা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছেন। এক তরুণ এসে তাঁর গতিরোধ করে। এর পর আরও তিনজন এসে ওই তরুণীকে টানাহেঁচড়া করতে থাকে, তাঁর কাঁধে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্র বের করে ভয় দেখালে তরুণী দৌড়ে পালান। দিনদুপুরে ঘটে এই ঘটনা। মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকায় ছিনতাইয়ের এ ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আরেকটি দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে বিজি প্রেসের সামনে। প্রিয় ডটকমের বার্তা সম্পাদক তানজিল রিমন ও এনটিভির কাঁকন রেজাসহ চার সাংবাদিক একটি প্রাইভেটকারে যাওয়ার সময় পেছনের দরজা টান মেরে খুলে গলায় চাপাতি ধরে মানিব্যাগ, মোবাইল ফোনসেট ও ক্রেডিট কার্ড ছিনিয়ে নেয় কয়েক ব্যক্তি। পরে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় এ ঘটনায় একটি মামলা হয়।
এমন ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা রাজধানীতে প্রায়ই ঘটছে। গত বৃহস্পতিবারও উত্তরায় ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয়ে বেইজিং হোটেলে ঢুকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। যানবাহন সংকটে পুলিশের টহল কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি। এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। কিছু এলাকায় নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাকরিচ্যুত অনেক সদস্য ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়েছে। এই অপরাধে তারা ব্যবহার করছে কালো কাচের গাড়ি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে কিনা সেটি বোঝা যায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে। সরকার পরিবর্তনের পর গত দুই মাসে ঢাকায় চাঞ্চল্যকর কিছু ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধে মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছেন ১০ জন। ৫ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন রিকশাচালক মো. সোহান। ১০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় রবিউল ইসলাম (৩৫) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড়ে বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাসা ও কার্যালয়ে ডাকাতি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরা ডাকাতরা নিজেদের যৌথ বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেয়। তারা ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে যায় বলে পুলিশকে জানিয়েছেন আবু বকর। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ১৬ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন মো. শাহনেওয়াজ (৩৮)। একই দিন ধানমন্ডিতে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রী ছিনতাইয়ের শিকার হন। হঠাৎ ছিনতাইকারীরা পিকআপ থেকে নেমে তাদের ওপর চাপাতি নিয়ে আক্রমণ করে। ওই শিক্ষকের স্ত্রীর হাত ভেঙে দিয়ে তারা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। ১৭ অক্টোবর শিয়া মসজিদ কাঁচাবাজার মার্কেট দখল নিয়ে বিরোধে মার্কেটের সভাপতি আবুল হোসেন (৫০) ও তাঁর ছোট ভাই মাহবুব (৪২) গুলিবিদ্ধ হন। ১৮ অক্টোবর সমন্বয়ক পরিচয়ে উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে একটি বাসায় হানা দেয় ৯-১০ জন। ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ড. মমতাজ শাহানারার কাছে তারা ২৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে রাজি না হলে এক পর্যায়ে তারা বাসায় লুটপাট শুরু করে, হাতিয়ে নেয় ৮৩ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১৫ লাখ টাকা।
১৯ অক্টোবর শাহজাহানপুর এলাকায় জুবায়ের হোসেন অলক নামে এক কনস্টেবলের বাসায় চুরি হয়েছে। পুলিশের রেকর্ড বলছে, গত ২০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে দিনের বেলা অস্ত্রের মুখে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এদিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৩ নম্বর সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী একটি গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনতাই করে কয়েক ব্যক্তি। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কুতুবখালী এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় মো. রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সমকালকে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশ একটি বিশেষ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তবে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশের সবাই দায়ী, এটা বলা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘অনেক দুর্ধর্ষ অপরাধী কারাগার থেকে বেরিয়েছে। তারা অপরাধের নতুন নকশা করছে। নিরাপত্তা ঘাটতির সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।’
তাঁর মতে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধীরগতিতে চলছে। কারণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কোনো সমালোচনা হলে, সেই দায় তারা নিতে চাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধের প্রতিবাদ ও ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
রাজধানীতে ছিনতাই-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি প্রতিরোধে পুলিশের টহল বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধী ছাড়া পেয়েছে, তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।’ কেউ অপরাধ করলে দ্রুত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলা নগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, শাহবাগ, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় চুরি-ছিনতাই বেশি ঘটছে।
দিনদুপুরে তরুণীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল প্রসঙ্গে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘চার ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা গ্রেপ্তার হলে বলা যাবে কেন ওই তরুণীর ব্যাগ ছিনতাই করেছে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য তারা এটি করতে পারে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এখন অপরাধীদের হাতে দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসবের মধ্যে গত ৫ আগস্ট বিভিন্ন থানা ও পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র রয়েছে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে তাদের ৫ হাজার ৭৩২টি অস্ত্র খোয়া গেছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৪ হাজার ২৮৩টি। অর্থাৎ এখনও পুলিশের ১ হাজার ৪৪৯টি অস্ত্রের খবর নেই। পাশাপাশি অপরাধীদের হাতে আগে থেকে রয়েছে অবৈধ অস্ত্র।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুলিশের টহল ও নজরদারি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। তবে ধীরে ধীরে টহল বাড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যেসব থানায় আগুন দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাক করে দ্রুত কার্যক্রম বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশের মনোভাব এখনও দুর্বল। তাদের মধ্যে মামলা ও বদলির আতঙ্ক কাজ করছে। আবার পুলিশের অনেক ইউনিটে এখন নতুন মুখ, যাদের সব কিছু গুছিয়ে নিতে সময় লাগছে।
অস্থির আন্ডারওয়ার্ল্ড
নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট অনেকে আশঙ্কা করছেন, ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে। কারণ জামিনে কারাগার থেকে বের হয়েছেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা মরিয়া।