নতুনের কেতন না উড়লে প্রগতির পথ রুদ্ধ হবে, কিন্তু তরুণদের এ উৎসাহ-উদ্দীপনা কি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গেই প্রাসঙ্গিক?
কাজী নজরুল ইসলাম ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামে নতুনের কেতন (পতাকা) উড়ানোর বিষয়টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন বলেই একসময় খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়। তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’ নজরুলের এ বিশ্বাস যে কতটা সত্য, সেটি সেই সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ তরুণ প্রমাণ করেছে এবং পরে এ তরুণরাই পাকিস্তানবিরোধী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্দোলনের পুরোভাগে থেকে সেই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে। শুধু বঙ্গবন্ধু নন, পৃথিবীর বহু দেশে, বহু নেতাই; যেমন-মাও জে দং, হো চি মিন, ফিদেল ক্যাস্ত্রোরা তাদের তরুণ বয়সে দেশের সংগ্রামে-বিপ্লবে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের কথা ধরা যাক। একবার দুজন বিখ্যাত গায়ক জর্জ মাইকেল ও এন্ড্রু রিজলি চীনে গেলেন। তাদের দেখে মানুষজনের মধ্যে কোনো উত্তেজনা দেখা গেল না; কিন্তু তারা দুজন মিলে যখন ‘হোয়েম’ বলে একটা পপ গ্রুপের নামে একটা কনসার্ট করলেন, দৃশ্যপট পালটে গেল। ১৯৮৫ সালের সেই কনসার্টে দর্শক-শ্রোতাদের ওপর নির্দেশ ছিল তারা যেন তাদের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকে, কিন্তু তরুণদের দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তারা বেশ আনন্দ পাচ্ছে। কারণ, সেটি এমন একটি সময়, যখন চীনের জনগণ ধীরে ধীরে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে। সেটি এমন এক সময়, যার পরের তিন দশকে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে, অনেক মানুষ বিদেশে ঘুরতে বা পড়তে যাবে এবং কমিউনিস্ট পার্টি তার কঠিন শাসন কিছুটা আলগা করে দেবে। সেটি ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য অনেক উচ্চাশা ও প্রত্যাশার সময়।
কিন্তু তরুণদের এ উৎসাহ-উদ্দীপনা কি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গেই প্রাসঙ্গিক? দেশের স্বাভাবিক নিয়মিত যে উন্নয়ন, সেখানে তাদের চিন্তা-ভাবনা বা আগ্রহ-উত্তেজনা কেমন ভূমিকা রাখে? সাধারণভাবে এ ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় বলে যেসব দেশে তরুণদের সংখ্যা বেশি, সেসব দেশ তাদের উন্নয়নের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু তরুণরা যদি নতুন করে কিছু ভাবার বা করার সুযোগ না পায় অথবা তাদের মধ্যে যদি উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব পরিলক্ষিত হয়, তাহলে কী হবে?
এখনকার স্রোত একটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৯০ ও ২০০০ দশকে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের জীবনটা আর পূর্বসূরিদের মতো নেই। ২০১২ সালে শি জিং পিং-এর ক্ষমতা গ্রহণের পর এখন সেখানে নেটদুনিয়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, অনেক কিছু সেন্সর করা হচ্ছে এবং তরুণদের নেতার ব্যক্তিগত মতবাদকে শিখে সেটি মেনে চলতে হচ্ছে। এদিকে চীনা অর্থনীতির উল্লম্ফনটাও কমে এখন থিতু হয়ে বসছে।
এতে কি চীনের তরুণরা বিক্ষুব্ধ? তারা কি সরকারবিরোধী হয়ে উঠছে? তা নয়। গত বছর তারা বিদ্রোহের মতো কিছু একটা করেছিল বটে, তবে তা ছিল খুবই দুর্বল। তাদের বিপ্লবী বা বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত তাদের ভেতর বিপ্লব বা বিদ্রোহের বীজ প্রোথিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি কখনো। তারা বড় হয়েছে ফায়ারওয়াল পরিবেষ্টিত নেটদুনিয়ায়; অনিয়ন্ত্রিত তথ্য বা খবর পাওয়ার বা দেখার সুযোগ ছিল না। জাতীয় মিডিয়ায় তারা তাদের পার্টির যেসব অর্জনের কথা শোনে, সেগুলো তারা বিশ্বাস করে এবং তারা তাদের পার্টিকে মনেপ্রাণে সমর্থন করে। এমনকি অনেক তরুণ এটাও মনে করে যে, পার্টি বরং তাদের বেশি স্বাধীনতা দিয়ে ফেলছে।
কিন্তু চীনা তরুণ-তরুণীরা যখন দেখে যে, তাদের দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে তারা যা শিখেছে সেটি দিয়ে তারা চাকরিদাতাদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না, তারা একটু দমে যায়, উদ্বেগে আক্রান্ত হয়। অনেকের কাছেই মনে হয়, সংসার করার জন্য যেটুকু সচ্ছলতার প্রয়োজন, সেটুকু সচ্ছল হয়তো তারা কোনো দিনই হবে না। তাদের সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটলে দেখা যায়, তারা দিন দিন বিষণ্ন হয়ে উঠছে। সেখানে যে দুটো শব্দের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি সেগুলো হলট্যাংপিং বা চিত হয়ে শুয়ে থাকা বা বাইলান অর্থাৎ কোনো কিছুকে পচে যেতে দেওয়া।
এ রকম হতাশ হতোদ্যম তরুণ যে কেবল চীনেই আছে তা নয়; সারা পৃথিবীর ‘জেন জি’ তরুণদের অবস্থা প্রায় একই রকম। ‘জেন জি’ হচ্ছে জি প্রজন্ম, যারা ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা ডিজিটাল যুগ, আবহাওয়াগত উদ্বেগ, দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কোভিড-১৯-এর মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। এ প্রত্যেকটি বিষয় তাদের নির্জীব ও বিষণ্ন মানসিকতা তৈরির জন্য কোনো না কোনোভাবে দায়ী। এরা ছোটবেলা থেকেই অনলাইনে কাজ করা, বাজার করা, খেলা করা, খবর পড়া, প্রেম করা বা বন্ধুত্ব করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ প্রজন্মের এশিয়ানরা এখন দিনে ছয় ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় তাদের মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই পার করে দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও ওই একই অবস্থা। ২০০৯ সালে সেখানকার মাধ্যমিকের ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছিল, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও বিষণ্নতা কাজ করে। ২০২১-এ এসে সেই সংখ্যাটা ৪৪ শতাংশ হয়ে যায়। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে যে সার্ভেটা হয়, সেখানে দেখা যায়, কোভিডের সময় চারজন মেয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন গভীরভাবে আত্মহত্যার চিন্তা করেছে। ছেলেদের মধ্যে এ সংখ্যাটা অবশ্য এর চেয়ে অনেক কম ছিল-প্রতি আটজনে একজন।
আমেরিকান গবেষকরা দেখেছেন কোভিড ছাড়া আরও যে তিনটি কারণে আমেরিকান তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ হতাশা, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। সেগুলো হলো- সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি, সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়া এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়া।
লিসা ডামুর নামের একজন ক্লিনিক্যাল মনোরোগবিদ বলেছেন, তরুণ-তরুণীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানসিক চাপে ভোগে। এ মানসিক চাপ বাড়ার কারণ সম্ভবত অস্ত্র-সন্ত্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, সাধারণভাবে দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবী এবং বিশেষ করে দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতি, কোভিড-১৯ এবং তার পরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বয়সের ৮৪ হাজার মানুষের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য সোশ্যাল মিডিয়াই সবচেয়ে বেশি দায়ী। আর কোভিডের সময় মানুষ যখন বাধ্য হয়ে সামাজিক যোগাযোগ কমিয়ে দেয়, তখন যে সেটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, সেটি এখন সর্বজনস্বীকৃত। তবে কোভিডের সময়ে তৈরি হওয়া অনলাইননির্ভরতা কোভিডের পরে যে চলে গেছে তা বলা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগ কমতে থাকার প্রবণতা এখনো বিদ্যমান এবং সেটি এখনো তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
যা হোক, এ সমস্যা সারা পৃথিবীর। সব দেশই এ সমস্যা সমাধান করার জন্য কোনো না কোনোভাবে চেষ্টা করছে বা করবে। কারণ, সবাই বোঝে নতুনের কেতন না উড়লে মানবসভ্যতার সব অগ্রগতি এক সময় থেমে যাবে। এক ধরনের প্রগতি হয়তো থাকবে, কিন্তু সেই প্রগতি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতৃত্বে হবে না, তার চালিকাশক্তি হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। নতুনের কেতন ওড়াতে না পারলে ভবিষ্যতের মানুষ এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর সব দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে একসময় কর্মহীন, চিন্তাহীন ও ‘প্রাণ’হীন জড়বস্তুতে পরিণত হবে।