USA

নতুন নথিতে খুনি ও দেশে দেশে সিআইএর চক্রান্ত নিয়ে যা জানা গেল

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির গুপ্তহত্যা নিয়ে গত মঙ্গলবার দুই হাজারের বেশি গোপন নথি প্রকাশ করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। এসব নথি প্রকাশে ছয় দশক পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড। জে এফ কে নামে পরিচিত সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে হত্যার ঘটনা ঘিরে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়েছে। এখনো এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

কেনেডি নিহত হওয়ার পর মার্কিন সরকার এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল, তা যে সঠিক নয়, নতুন প্রকাশিত নথিতে এর পক্ষে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেসব গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিল মঙ্গলবার প্রকাশিত নথিতে নতুন করে তা আলো ফেলেছে। এসব নথিতে কেনেডির হত্যাকারী সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে।

১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাসের ডালাস শহরে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা কেনেডিকে হত্যা করা হয়। ঘাতক ছিলেন লি হার্ভে ওসওয়াল্ড নামে ২৪ বছরের এক তরুণ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক একজন মেরিন সদস্য। টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরির ষষ্ঠ তলা থেকে কেনেডিকে নিশানা করে গুলি ছোড়েন ওসওয়াল্ড। এর দুদিন পরের ঘটনা। ওসওয়াল্ডসহ বন্দীদের অন্য একটি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ সময় জ্যাক রুবি নামে এক নৈশক্লাব মালিকের গুলিতে নিহত হন ওসওয়াল্ড।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাসে জন এফ কেনেডি মেমোরিয়াল প্লাজা

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাসে জন এফ কেনেডি মেমোরিয়াল প্লাজা

কেনেডির মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হন লিন্ডন বি জনসন। এই হত্যাকাণ্ড তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে দেন। এই কমিশনের প্রধান করা হয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেনকে। তদন্তে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৬৪ সালে কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ওসওয়াল্ড একাই কেনেডিকে হত্যা করেছেন। তাঁর সঙ্গে আর কারও জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

নতুন করে যেসব নথি প্রকাশিত হয়েছে তাতে কি ওয়ারেন কমিশন এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে উপসংহারে উপনীত হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি করেছে? ট্রাম্প প্রশাসন থেকে প্রকাশিত এসব নথিতে নতুন কি তথ্য উন্মোচিত হয়েছে? এমন সময়ে এসে এসব নথি উন্মুক্ত করা কি কোনো গুরুত্ব বহন করে? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা।

এসব নথি কি হত্যা নিয়ে নতুন তথ্য সামনে এনেছে?

কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে ব্যাখ্যা বা বয়ান, তা কয়েক দশক পরেও বেশির ভাগ আমেরিকান বিশ্বাস করেননি। এ নিয়ে ২০২৩ সালে একটি জরিপ চালায় জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ। তাতে উঠে আসে, ওয়ারেন কমিশনের উপসংহার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন ৬৫ শতাংশ আমেরিকান।

মঙ্গলবার ট্রাম্প প্রশাসন নতুন করে হাজারো নথি প্রকাশ করার পর এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে আল-জাজিরা। এসব বিশেষজ্ঞ বলছেন, নতুন নথিতেও ওয়ারেন কমিশনের টানা উপসংহার ছাড়া তেমন নতুন কিছু সামনে আনেনি।

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার প্রেসিডেনশিয়াল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মার্ক সেলভারস্টোন বলেন, ‘ওসওয়াল্ড একাই গুলি করে জন এফ কেনেডিকে হত্যা করেন এবং এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না— দীর্ঘদিনের যে এই বয়ান নতুন প্রকাশিত নথি তাতে কোনো পরিবর্তন এনেছে বলে আমার মনে হয় না।’

ঘাতক সম্পর্কে নতুন কিছু কি জানা গেল?

নতুন প্রকাশিত নথির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কেনেডিকে হত্যার আগে মেক্সিকো সিটিতে (মেক্সিকোর রাজধানী) অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার দূতাবাসে গিয়েছিলেন ঘাতক ওসওয়াল্ড।

একটি নথিতে কিছু গোয়েন্দা প্রতিবেদন রয়েছে। সেসব প্রতিবেদনে ওসওয়াল্ড কখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। সেই নথি অনুযায়ী, চাকরি ও মার্কিন নাগরিকত্ব ছেড়ে ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাড়ি জমান ওসওয়াল্ড। তিন বছর পর ১৯৬২ সালে আবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন।

ওই নথিতে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির নিকোনভ নামে একজন গুপ্তচরের নাম রয়েছে। তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থায় থাকা নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছেন, ওসওয়াল্ড কখনো কেজিবির গুপ্তচর ছিলেন কি না।

মার্কিন সরকারের নজরদারিবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওসওয়াল্ড যুক্তরাষ্ট্রে আবার ফিরে আসার পর তাঁর গতিবিধি নিবিড়ভাবে নজরদারি করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওসওয়াল্ড গুলি চালানোর ক্ষেত্রে তেমন দক্ষ ছিলেন না বলে ধারণা করা হয়।

এসব নথি থেকে সিআইএর অভিযান সম্পর্কে কি বিস্তারিত কিছু জানা গেছে?

স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া এসব নথিতে। এর মধ্যে ‘অপারেশন মোঙ্গুজ’ নামে একটি অতি গোপন অভিযানও রয়েছে। কিউবার কমিউনিস্ট সরকারকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফেলে দেওয়ার লক্ষ্যে গোপনে এই অভিযান চালায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

আরেকটি নথিতে দেখা গেছে, সিআইএ বিভিন্ন দেশে দেড় হাজার গুপ্তচর পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের মার্কিন দূতাবাসেই পাঠানো হয়েছিল ১২৮ জন গুপ্তচর। এসব গুপ্তচর নিজেদের মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। জন এফ কেনেডির একজন শীর্ষ উপদেষ্টা আর্থার শেলিসিঙ্গার জুনিয়র সতর্ক করে বলেছিলেন, এভাবে কর্মকর্তা সাজিয়ে গুপ্তচর পাঠানোর চর্চা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে খর্ব করবে।

বিভিন্ন দেশে সরকার উৎখাতের ক্ষেত্রে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে এসব নথি থেকে। যেমন ১৯৬৩ সালে সিআইএর পরিচালকের কার্যালয়ের সঙ্গে কিউবায় থাকা মার্কিন গুপ্তচরদের যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে এসব নথিতে। কিউবায় থাকা এসব মার্কিন গুপ্তচর ১৯৫৯ সালে ক্ষমতায় আসা ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত করছিল।

পেনসিলভানিয়ার ভিয়ানোভা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড ব্যারেট আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, (মার্কিন সরকার ও গুপ্তচরেরা) কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল।’

প্রকাশ হওয়া নথির মধ্যে সিআইএর একটি মেমো রয়েছে। তাতে ই৪ডিইইডি নামে একটি গোপন অভিযানের বিস্তারিত জানা গেছে। ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ট্রুজিলোর সরকারকে উৎখাতের জন্য এই অভিযান চালিয়েছিল সিআইএ।

১৯৬১ সালের মে মাসে গুপ্তহত্যার শিকার হন রাফায়েল ট্রুজিলো। গাড়িতে করে সান ক্রিস্তোবাল যাওয়ার পথে ট্রুজিলোকে গুলি করে হত্যা করেন এক বন্দুকধারী। এর এক বছর আগেই ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র।

কেনেডি হত্যা নিয়ে কতটি নথি প্রকাশিত হয়েছে?

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল আর্কাইভসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবারের আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯৯২ সালের জেএফকে রেকর্ডস অ্যাক্ট নামের একটি আইনের অধীনে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ৯৯ শতাংশ নথি পর্যালোচনা করেছিল। এই সংখ্যাটা প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার।

ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত সব নথি প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সিআইএ ও এফবিআইয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করতে পেরেছিলেন মাত্র ২ হাজার ৮০০টি নথি।

ট্রাম্পের পর জো বাইডেনের প্রশাসন আরও প্রায় ১৭ হাজার নথি প্রকাশ করে। এরপর প্রকাশ হতে বাকি থাকে মাত্র ৪ হাজার ৭০০টি নথি। গত মাসে এফবিআই জানায়, অতিরিক্ত আরও ২ হাজার ৪০০টি নথি পাওয়া গেছে।

সোমবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, এসব নথির জন্য লোকজন দশকের পর পর দশক অপেক্ষায় আছেন। তবে দেখা গেছে, নতুন করে যেসব নথি প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেক নথির অনুলিপি রয়েছে, যা আগেই প্রকাশিত হয়েছে এবং এসব সম্পর্কে মানুষ জানে।

জেএফকে হত্যাকাণ্ড নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যেসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চালু আছে, নতুন প্রকাশিত নথির কারণে সেসব যে ভিত্তি পেয়েছে, এমনটা মনে হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডেভিড ব্যারেট বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত চমক তৈরি করার মতো কোনো কিছু সম্পর্কে কিছু শুনিনি।’

২০২৩ সালে পরিচালিত গ্যালাপের জরিপ অনুযায়ী, আমেরিকানদের ২০ শতাংশ বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেনেডিকে হত্যা করেন ওসওয়াল্ড। আর ১৬ শতাংশের ধারণা, ওসওয়াল্ড সিআইএর লোক ছিলেন। তবে মঙ্গলবার প্রকাশিত নথিতে এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো বিদেশি শত্রুরা এই হত্যার চক্রান্ত করেছিল। কারও এমন দাবি, প্রেসিডেন্ট হওয়ার খায়েশ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জনসন। কেউ কেউ মনে করেন, এটা কোনো মাফিয়া চক্রের কাজ। নতুন করে প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা যায়, সবই অন্তঃসারশূন্য।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d