নতুন শুল্ক নীতির আবহে ভারতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্স

চীনের সাথে আমেরিকার এই মুহূর্তে যা সম্পর্ক তাতে ভারতের সাথে তাদের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো রাখা প্রয়োজন।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স সোমবার দিল্লি এলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তার বৈঠক হবে। মঙ্গলবার জয়পুরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সভায় ভাষণ দেবেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বজোড়া শুল্ক যুদ্ধের মধ্যেই ভারতের মাটিতে পা রাখলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। সাথে ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী ঊষা, দুই ছেলে ও কন্যা। সোমবার দিল্লির পালাম টেকনিক্যাল বিমানবন্দরে তাদেরকে স্বাগত জানান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব।
অক্ষরধাম মন্দিরে
ভারতে পা রেখেই সপরিবারে অক্ষরধাম মন্দিরে যান ভান্স। সোমবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠক এবং নৈশভোজের পর জয়পুর এবং আগ্রায় যাবেন ভান্স। তবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাজস্থান ইন্টারন্যাশানাল সেন্টারে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সভায় বক্তব্য রাখবেন তিনি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপিকা ঈশানী নস্কর ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ভাইস প্রেসিডেন্টের ভারত সফর ‘কূটনৈতিক হওয়া সত্ত্বেও অনেকাংশে পারিবারিকও‘। তিনি বলেছেন, ‘ভান্স তার পরিবারকে নিয়ে ভারতে এসেছেন। আগ্রার তাজমহল, রাজস্থানের কেল্লা, অক্ষরধাম মন্দির ভ্রমণের মাধ্যমে একটি পারিবারিক সফরও হচ্ছে। তবে এই সফরও যে কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
বাণিজ্য মহলে চাঞ্চল্য
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বব্যাপী শুল্ক ঘোষণার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্সের ভারত সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্পের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে উত্তাল সারা বিশ্ব। এই শুল্ক ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত থাকলেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বাণিজ্য মহলে এর প্রভাব পড়েছে। চীন এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভান্সের ভারত সফর তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিদেশ নীতি বিশেষজ্ঞ তানভির আরশাদ ডিডাব্লিউকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘ভান্সের এই ভারত সফর কেবলমাত্র এই দুই দেশ নয়; বরং সারা পৃথিবীর কাছে তাৎপর্যপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সব থেকে বড় বাণিজ্য পার্টনার। ২০২৪ দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এই অংক ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলেই মনে হয়। ট্রাম্পের নয়া শুল্কনীতির আবহে দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তি কীভাবে তরান্বিত করা যায় সেই বিষয় প্রধানমন্ত্রী ও ভান্সের আলোচনা হবে।‘
তানভিরের মতে বাণিজ্য চুক্তি ছাড়াও প্রতিরক্ষা এবং অভিবাসন নিয়ে আলোচনা হতে পারে দুই দেশের মধ্যে। তিনি বলেন। ‘ভারত আমেরিকার থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কিনবে কিনা এবং ট্রাম্পের নতুন অভিবাসন নীতির মধ্যে ভারতীয়দের জন্য এইচ ওয়ান বি ভিসা প্রক্রিয়া সরলীকরণ করা যায় কিনা সেই বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।‘
ভূরাজনীতিতে প্রভাব
তবে এর মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে ভারতের বৈঠক ভূ-রাজনীতর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তানভিরের মতে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতের রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক অবস্থা সব থেকে স্থিতিশীল। ট্রাম্পের নয়া উদারনৈতিক নীতির ফলে চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক আরো জটিল হয়েছে। এই অবস্থায় ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক ভূ-রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেবে।‘
ঈশানী জানিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষাসহ একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যেই সেই চুক্তি সই না হলেও বিষয়গুলো নিয়ে আরেক প্রস্থ আলোচনা হবেই।’ ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে তানভিরের সাথে অনেকাংশে একমত ঈশানী।
তিনি বলেন, ‘চীনের সাথে আমেরিকার এই মুহূর্তে যা সম্পর্ক তাতে ভারতের সাথে তাদের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো রাখা প্রয়োজন। ট্রাম্প কঠোর হাতে নয়া উদারীকরণ নীতি প্রণয়ন করতে চাইছেন। এর ফলে ভারত সম্পর্কেও নানা মন্তব্য করেছেন। ভারতের ধীরে চলো নীতি সেই জায়গায় কাজ দিয়েছে। ভান্সই ভারত এবং আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের সেতু হয়ে উঠতে পারেন। এই সফর সারা পৃথিবীকে অন্তত সেই বার্তা দিচ্ছে।’
‘ভান্স উদ্ধত, দুর্বিনীত‘
অন্যদিকে, জেডি ভান্সের ভারত সফর নিয়ে ‘শঙ্কিত‘ সাবেক শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিকর্তা এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ জহর সরকার। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন প্রশাসনের অন্যান্য নেতাদের মতোই ভান্স উদ্ধত এবং দুর্বিনীত। ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পরেও ভান্স-সহ প্রশাসনের অন্যান্যদের আচরণ এবং বক্তব্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে আঘাত করেছে। অনেক দেশের কাছেই এখন চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ‘লেসার ইভিল‘ হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে কোনো দ্বিপক্ষীয় লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না।
‘অন্যদিকে, আমার আশঙ্কা, এই দুই নেতার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির নামে কোনো অশুভ আঁতাত তৈরি হতে পারেো। আনুষ্ঠানিক প্রেস বিজ্ঞপ্তির আড়ালে তা হয়ত ঢাকা পড়ে যাবে। আমরা জানতেও পারব না।’