নতুন সঙ্কটে দেশের অর্থনীতি
ইরান-ইসরাইলের হামলা-পাল্টা হামলা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার প্রথম ভিকটিম হবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো : অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান দেশের তৈরি পোশাক ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে : প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান লোহিত সাগর সঙ্কট শুরুর পর ঢাকা থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে : সিদ্দিকুর রহমান বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে
ইরান-ইসরাইল হামলা-পাল্টা হামলায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। দুই দেশের মধ্যকার এই বিরোধ নতুন করে সংকটে ফেলতে পারে দেশের অর্থনীতি। আমদানি-রফতানিতে খরচ বেড়ে গেলে দেশের অর্থনীতিকে নতুন চাপের মুখে ফেলবে। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফিতি, ডলার সঙ্কট, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় নিম্নগামী, কমছে রিজার্ভ, মিশ্র রফতানি প্রবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপসহ আর্থিকখাতের সব সূচকই নিম্নমুখী। করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ দীর্ঘদিন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশীয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে সঙ্কট বিরাজমান। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা, ব্যাংক একীভূতকরণসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিলেও হঠাৎ করে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব চলমান এই সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাব আরও দীর্ঘায়িত করেছে। ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব একটি নতুন উদ্বেগ বা হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা। ইসরাইলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিশোধ নিতে ইরানে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে ইসরায়েল। এর ঘটনায় হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে সোনা ও তেলের দাম।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান বলেন, ইসরায়েল-হামাস এর সংঘাতের পথ ধরে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতার কোন কিনারা না হতেই ফের ইসরায়েল-ইরান সংঘাত গোটা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার প্রথম ভিকটিম হবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো। চলমান এই সংকটকে ‘দীর্ঘমেয়াদি’ উল্লেখ করে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে শুধুমাত্র গার্মেন্টস আর রেমিটেন্স নির্ভর হয়ে না থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কূটনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান গাজা যুদ্ধের মাঝে নতুন করে ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে বড় সংঘাতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর ইতোমধ্যে স্বর্ণ ও অপরিশোধিত তেলের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছে। একই সঙ্গে এশিয়ার শেয়ার ও বন্ডে ধস নেমেছে।
এর ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ ও শিপিংয়ের সময় বাড়বে যা সমুদ্রপথে বাণিজ্যব্যয়কে বাড়িয়ে দিবে। বিশেষ করে জ্বালানিব্যয় আকাশচুম্বী হবে। এছাড়া যুদ্ধের ধাক্কা অনিবার্যভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বসবাসরত পর্যটন ও অন্যান্য সেবা খাতে পড়বে। যা ওখানকার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবিকাকে প্রভাবিত করবে। এতে ওই দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাবে। এছাড়া সংঘাত বাড়লে বৈশ্বিক অর্থনীতি নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করবে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে চাহিদা হ্রাস পেতে পারে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি নতুন করে উদ্বেগের মুখে পড়েছে। দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেনÑ ব্যবসার খরচ আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, লোহিত সাগর সঙ্কট শুরুর পর ঢাকা থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে তা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সূত্র মতে, ইরানের বড় পরিসরে তেলের মজুত রয়েছে। ওপেক দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক এটি। আমেরিকান ব্যবসায়িক নিউজ চ্যানেল সিএনবিসি’র মতে, বিশ্ববাজারে ইরানের তেল সরবরাহ করার সক্ষমতায় কোনো বাধা পড়লে তেলের দাম বাড়তে পারে। হরমুজ প্রণালির সম্ভাব্য বন্ধ এ পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
সিএনবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আঞ্চলিক যুদ্ধের নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার বা তারও বেশি ছাড়াতে পারে। লিপো অয়েল অ্যাসোসিয়েটস-এর প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি লিপোর বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইরানের তেল উৎপাদন বা রপ্তানি সুবিধার ওপর যেকোনো আক্রমণ ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে পারে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে দাম ১২০ থেকে ১৩০ ডলারে উঠতে পারে। এদিকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ইরানের ভারী অপরিশোধিত তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ৮৩ দশমিক ৪৮ ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের মাসের তুলনায় ৩ দশমিক ১৪ ডলার বৃদ্ধি। এছাড়া ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ওপেক-এর গড় তেলের মূল্য ৮৪ দশমিক ২২ ডলারে পৌঁছে যা পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় ২ দশমিক ৯৯ ডলার বৃদ্ধি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
এমএসসিআইয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক শেয়ারের বিস্তৃত সূচক ২ শতাংশ কমেছে এবং ইউএস স্টক ফিউচার ১ শতাংশ কমেছে। মার্কিন দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি ইয়েল্ড ৯ বেসিস পয়েন্ট কমে ৪ দশমিক ৫৫৬৭ শতাংশে নেমেছে, যা আগে ১৫ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমেছিল। এছাড়া ডলারের বিপরীতে ইয়েনসহ অন্যান্য মুদ্রার দর ওঠা-নামা করছে। পাশাপাশি এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর স্বর্ণের দামও বেড়েছে। ওসিবিসির বিনিয়োগ কৌশল বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাসু মেনন বলেন, ইরান পরবর্তীতে কী করবে তা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন এবং বাজার অস্থির থাকবে।
এদিকে ইরান-ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যের এ যুদ্ধের প্রভাব জ্বালানি বাজারকে অস্থিতিশীল এবং তার দরুন জ্বালানির দামে অস্থিরতা অনেকটা ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে যেমনটা ঘটেছিল তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের তেল ও এলএনজি আমদানি বিলের দায় আরও বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলায় ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত লোহিত সাগরের শিপিং রুট বাড়তি বাধার সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালিতে আরও জটিলতা দেখা দিলে চলমান পরিস্থিতি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এ নৌপথটি দিয়ে প্রতিদিন বৈশ্বিক তেল উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ পরিবাহিত হয়। এর ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ ও শিপিংয়ের সময় বেড়ে যাবে।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রধান রফতানি আয়ের খাত পোশাক রফতানি নতুন করে উদ্বেগের মুখে পড়েছে। পোশাক রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেনÑ ব্যবসার খরচ আরও বাড়বে। কারণ, এই উত্তেজনা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নিলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে। ফলে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের খরচ বেড়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। বিদেশি ক্রেতারা ইতোমধ্যে রপ্তানিকারকদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পণ্য সরবরাহ করতে বলেছেন। কেননা, গত অক্টোবরে লোহিত সাগর সঙ্কটের পর পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত ১৫ দিন সময় দেয়া হয়েছে। সুয়েজ খালের মাধ্যমে এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী লোহিত সাগরে সঙ্কট বৈশ্বিক উত্তেজনার কেন্দ্র হিসেবে দেখা দেওয়ার আগে চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপের বন্দরে পণ্য পাঠাতে সাধারণত ৩০ দিন লাগত।
সেই নৌপথে চলাচলকারী জাহাজগুলো লক্ষ্য করে হুথিদের হামলার কারণে এমনিতইে পণ্যবাহী জাহাজগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ ঘুরে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার ঘুরে যাওয়ার কারণে পণ্য সরবরাহে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত দেরি হচ্ছে এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই সঙ্কটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান উত্তেজনার আগেই বেশ কয়েকটি খুচরা পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বাধা এড়াতে কিছু পণ্যের কার্যাদেশ বাংলাদেশ থেকে তুরস্ক বা ভিয়েতনামে সরিয়ে নিচ্ছে। এরমধ্যে নতুন করে মধ্যপ্রাচ্য ইরান-ইসরায়েল সঙ্কট।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন বলেন, এমনিতেই লোহিত সাগর সঙ্কটের কারণে বিদেশি ক্রেতারা রফতানিকারকদের কম দাম দিয়ে জাহাজ পরিচালনার খরচ তুলে নিচ্ছে। রফতানিকারকরা বলছেন, যদিও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজ চলাচলের খরচ বহন করে তবু অনেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রফতানিকারকদের ওপর খরচ চাপিয়ে দেন। ৯৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ক্রেতারা ফ্রেইট অন বোর্ড পদ্ধতিতে পণ্য কেনায় জাহাজের খরচ দিয়ে থাকেন। রফতানিকারকরা পাঁচ শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ দেন। একই সঙ্গে ক্রেতারা যেকোনো অতিরিক্ত খরচ রফতানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দেন। তাই কারখানার মালিকরা আশঙ্কা করে বলছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বাড়লে তা বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে প্রভাব ফেলবে। মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট চললে সউদী আরব, কুয়েত, ইরাক ও ইরানের মতো উদীয়মান বাজারগুলোয় পোশাক বিক্রি ততটা সহজ হবে না।
বেসরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের সিইও ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হলে তা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানি বিল বাড়ানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে। সরকার বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপথে বাণিজ্যব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সংঘাত বাড়লে বৈশ্বিক অর্থনীতি নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করবে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে চাহিদা হ্রাস পেতে পারে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।