নতুন ৬৮ মামলা, গ্রেপ্তার ৬৪২
বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে প্রিজন ভ্যানে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ঢাকায় ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে হওয়া সংঘর্ষের পর দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে দলটির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে।
ঢাকা ও ২২টি জেলা থেকে পাওয়া হিসেবে, গতকাল সোমবারই মামলা হয়েছে ৬৮টি। এসব মামলায় ৫ হাজার ৫৫৯ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি অসংখ্য। সারা দেশে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৪২ জনকে।
ঢাকায় শনিবারের সংঘর্ষের রবি ও সোমবার মামলা হয়েছে ৩৭টি। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৫৪৪ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭১৬ জনকে।
আসামিদের তালিকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা রয়েছেন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় গ্রেপ্তার মির্জা ফখরুলকে রোববার কারাগারে পাঠানো হয়। দলটির জেলা পর্যায়ের নেতাদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার–আতঙ্কের মধ্যে শীর্ষ নেতারা অজ্ঞাত অবস্থানে রয়েছেন। এর মধ্যে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গত রোববার তিন দিনের সড়ক, রেল ও নৌপথে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আজ মঙ্গলবার থেকে এই অবরোধ কর্মসূচি শুরু হবে, শেষ হবে বৃহস্পতিবার।
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ও বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের পরিকল্পনা নিয়ে গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে কথা বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন।
তিনি বলেন, কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিএনপি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে আইন প্রয়োগ করা হবে।
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র যাঁরা বিশৃঙ্খলা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ওই দিন যাঁরা বিশৃঙ্খলা করেছেন, তাঁদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী মামলা ও গ্রেপ্তার করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে না। পেশাদারির সঙ্গে মামলা রুজু করা হচ্ছে এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও মামলা করছেন।
২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশের অন্তত ছয়টি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এরপর পুলিশের অভিযানের মুখে দলটির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। পরদিন রোববার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে বিএনপি।
দুই দিনে এক পুলিশ সদস্যসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর যেসব মামলা দেওয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগের বাদী পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা।
বিভিন্ন মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মামলাগুলোতে পুলিশকে হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি কাজে বাধা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর, পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া, বাসে আগুন দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঢাকায় ৩৭ মামলা, আসামি ১,৫৪৪
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখা থেকে গতকাল পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ এবং হরতালের পর গতকাল নতুন করে ৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৫৯৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে দুই দিনে ঢাকায় মোট ৩৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১ হাজার ৫৪৪ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি অসংখ্য।
মির্জা ফখরুল ছাড়া আসামির তালিকায় রয়েছেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকতউল্লা বুলু, জয়নুল আবদিন ফারুক, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ওমর, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অনেকে।
বিএনপি জানিয়েছে, শনিবার ঘটনার পর ঢাকায় পাঁচজন শীর্ষ নেতাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় দলের নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বাসায় বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
এদিকে আদালত থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল নতুন করে ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করেছে ডিএমপি। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
২২ জেলায় ৫৭ মামলা
প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, ২২ জেলায় গতকাল নতুন করে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার ৯৬৫ জনকে। নারায়ণগঞ্জের একটি মামলায় বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীসহ ২৮২ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে।
জেলায় যেসব মামলা হয়েছে, সেসব মামলায় বিএনপির জেলা পর্যায়ের শীর্ষ ও সক্রিয় নেতাদের অনেককে আসামি করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম, যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সাবেরুল হক, ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া, ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম কাইয়ুম, মাগুরা জেলা যুবদলের সভাপতি ওয়াসিকুর রহমান প্রমুখ।
২১ জেলায় গ্রেপ্তার ৪৭৪
দেশের ২১ জেলা থেকে গতকাল বিএনপি ও দলটির অঙ্গসংগঠনের ৪৭৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসব জেলায় দুই দিনে ১ হাজার ৫৮৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজশাহীতে গতকাল ৯০, যশোরে ৬৬, নেত্রকোনায় ৫০, ফেনীতে ৫০, ময়মনসিংহে ৪৫, সিরাজগঞ্জে ৩৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩২, সাতক্ষীরায় ৩২, কিশোরগঞ্জে ১৫, সিলেটে ৮, খুলনায় ৭, জামালপুরে ৬, টাঙ্গাইলে ৬, মানিকগঞ্জে ৬, লালমনিরহাটে ৫, কুষ্টিয়ায় ৫, ফরিদপুরে ৪, গাইবান্ধায় ৪, মাগুরায় ৩, হবিগঞ্জে ২ ও চাঁদপুরে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের কঠোর অবস্থান রয়েছে। নেতা-কর্মীরা যেন মাঠে নামতে না পারেন, সে জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা কর্মসূচি পালন করতে তৎপর হলেই গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানিয়েছে, পুলিশের লক্ষ্য হলো বিএনপির শীর্ষ ও সক্রিয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা, যাতে সংগঠিত হতে না পারেন।
বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই বিপুল মামলা রয়েছে। দলটির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখার গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত হিসাবে, বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। ২০০৯ সাল থেকে মামলাগুলো হয়েছে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে তাদের মহাসমাবেশ পণ্ড করার পর নতুন করে এখন মামলা ও গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে, যাতে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সংগঠিত হতে না পারে। দলটির দাবি, মহাসমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখে সরকার এই কৌশল নিয়েছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল অজ্ঞাত স্থান থেকে ভার্চ্যুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকার তাঁদের আন্দোলন বিফল করতে দমন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এসব করে আন্দোলন দমানো যাবে না। কারণ, জনগণ তাঁদের সঙ্গে রয়েছে।