Trending

নদী গ্রাসে ২৬৫ বালুখেকো

দখল-দূষণে সংকুচিত হয়ে আসছে দেশের নদনদী। আবার অনেক নদী হারিয়েও গেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৬৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নদনদী থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন করছে। যাদের মধ্যে ৫৪ জন সরাসরি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নেতা, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। ছয়জন ব্যবসায়ী, ১২ জন ড্রেজার মালিক-বালু ব্যবসায়ী এবং ১৯৩ জন প্রভাবশালী। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে আইনের কোনো তোয়াক্কা করছেন না তারা। বালু তোলার কারণে নদীভাঙন বাড়ছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপরও। ড্রেজার ও পাওয়ার পাম্প লাগিয়ে বালু উত্তোলনে বিধিনিষেধ থাকলেও কিছুই মানছে না বালুখেকোরা। এভাবেই এক হাজারের বেশি বালুমহালে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে নদীর সর্বনাশ ডেকে আনছে তারা।

গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে জাতীয় নদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বালুমহালের ওপর করা এক গবেষণা ফলাফলে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) আয়োজিত ‘নদীর অধিকার’ শীর্ষক ওই সেমিনারে ইউএসএআইডির সহায়তায় যুক্ত ছিল ১২টি সংগঠন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতারা এতে বক্তব্য দেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কোন নদীতে কী পরিমাণে বালু আছে, সেগুলোর কতটুকু উত্তোলন করা যাবে এবং কোথা থেকে তোলা উচিত– এ ব্যাপারে কোনো সমীক্ষা নেই। সরকারি হিসাবে দেশে বালুমহালের সংখ্যা ৭০৭। বিভিন্ন নদনদীর ৫৫৫টি স্থানকে বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। এর ৫৪ শতাংশ আবার বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর বাইরেও দেশের ৭৭টি নদীর ১৪২টি এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করছেন প্রভাবশালীরা। আবার তারা ইজারা নিচ্ছেন এক জায়গার আর বালু তুলছেন আরেক জায়গা থেকে। ফলে নদী ও বসতি এলাকা– সবখানে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদনদীগুলো অবৈধ বালু উত্তোলনের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে। নদনদী ছাড়াও হাওর, খাল-বিল ও বঙ্গোপসাগর থেকেও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা যথেচ্ছভাবে বালু তুলছেন। এতে নদীর পাড় ভাঙন থেকে শুরু করে গতিপথ বদলে যাওয়া এবং মাছ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদী দখল ও দূষণের পাশাপাশি এসব অপতৎপরতা দেশের নদনদীর জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

দেশের নদনদীগুলোর কোন এলাকা থেকে কতটুকু বালু উত্তোলন করা যাবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, এ ধরনের সমীক্ষা ছাড়া বালু উত্তোলন করলে দেশের সব জলাভূমি নষ্ট হয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের নদনদীগুলোর স্বাস্থ্য কেমন আছে, তা নিয়মিতভাবে তদারকি ও বোঝার জন্য রিভার হেলথ কার্ড তৈরি করতে হবে। ওই কার্ড থেকে বোঝা যাবে, নদীগুলোর পরিবেশগত ও নাব্যের স্বাস্থ্য খারাপ, নাকি ভালো হলো। দেশের কোথাও নদী দখল বা দূষণ হলে তা জানানোর জন্য একটি হটলাইন নম্বর চালু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহাদ মোল্লা বলেন, বালু উত্তোলনের জায়গাগুলো পরিদর্শন করতে হবে; কতটুকু বালু তোলা হবে, কোথা থেকে তুলতে হবে– তা নির্দিষ্ট করতে হবে।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও নদীর সঙ্গে আমাদের দূরত্ব হয়ে গেছে। নদীকে জানতে হলে নদীর কাছে যেতে হবে, নদীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।

প্রভাবশালী বালুখেকো কারা

চাঁদপুর সদরের ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান, পাবনার সুজানগরের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল ওহাব এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীনুজ্জামান শাহীন, মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোল্লা ফরিদ এবং গালা ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুলাল সূত্রধর, রংপুরের মিঠাপুকুরের সাংবাদিক সংগঠনের সদস্য স্থানীয় মরাহাটি এলাকার বাসিন্দা শাহীন মণ্ডল, ফরিদপুরের মধুখালীর ড্রেজার মালিক আল আমীন ও রেজাউল মোল্যা, নওগাঁর আত্রাইয়ের ব্যবসায়ী সায়েম, পটুয়াখালীর বাউফলের ইউপি সদস্য মো. শাহজাহান গাজী ও তাঁর ভাই মো. কাশেম গাজী, মো. আফজাল গাজী ও রাব্বী গাজী, সিলেটের জৈয়ন্তাপুরের ৪ নম্বর বাংলাবাজার বালু-পাথর ব্যবসায়ী সমিতি, কুমিল্লা মুরাদনগরের  উপজেলা যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল হাই, ১ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মো. জমির উদ্দিন, ৪ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মো. রমজান আলী, ৫ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মো. দেলোয়ার হোসেন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডি এম হোসেন, রংপুরেরর গঙ্গাচড়ার মর্নেয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহসীন আলী, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোনা মিয়া, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. আলী আজগর জাহাঙ্গীরের ভাই জালাল উদ্দিন ও তাদের সহযোগী মাইন উদ্দিন, কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোশারফ হোসেন মিন্টু ও উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মো. মোশারফ হোসেন মুসা, ফরিদপুর সদর উপজেলার মামা-ভাগ্নে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. এমদাদুল হক ও মক্কা এন্টারপ্রাইজের মো. মুক্তার হোসেন ও মদিনা এন্টারপ্রাইজের মো. টিটু, ভোলার লালমোহনের ধলীগৌরনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হেদায়েতুল ইসলাম মিন্টুর ভাই মো. আলমগীর সিকদার, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ভাতিজা সাইফুল দেওয়ান, খবির দেওয়ান, নুরু খান, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নাজির খান, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মিজান সরদার, কুষ্টিয়া সদরের উত্তর বড়দল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি মাশুক মিয়া, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের চরকিশোরগঞ্জ গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রাসেল উদ্দিনের নেতৃত্বে সোহেল রানা, শামীম আহম্মেদ স্বপন, আরমান, তুষার, ফিরোজ মিয়া, হোসেন আলী, মোসলেম মিয়া, মোহাম্মদ মিন্টু, মুকুল, মুরাদ, সোহাগ, শাহাদাত মিয়া, সাকিব আহম্মেদ, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চাঁনপুর ইউনিয়নের জব্বার মিয়ার ছেলে সুলতান মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন আয়নাল, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া বাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ হাওলাদার, রনগোপালদী বাজারের ফার্মেসি ব্যবসায়ী মহিবুল মৃধা, মানিকগঞ্জের দোহারের প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা শহিদ এবং মুক্তার, সুনামগঞ্জের ইউপি সদস্য মো. আর্শাদ মিয়া।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button