Bangladesh

নয়া কিসিমের এক সংসদের যাত্রা শুরু

গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ সংসদের যাত্রা শুরু হলো। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেমন ছিল, এটা আদৌ কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল কিনা এ বিষয়ে পুনরায় কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে অধিবেশনের ১ম দিন থেকে শুরু অদ্যাবধি ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় যেমন রাষ্ট্রপতিসহ অন্যান্য সংসদ সংদস্যদের বক্তব্য, বিরোধী দল গঠন ও সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্যদের মনোনয়নের দায়িত্ব (প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রদান) ইত্যাদির দিকে দৃষ্টিপাত করলে মেঘ দেখলে যেমন বৃষ্টি হবে কিনা অনুমান করা যায়, তদ্রুপ এ সংসদের দ্বারা আর যাই হোক অবাধ ও স্বাধীন গণতন্ত্রের চর্চা হবে না এটা নিঃন্দেহে বলা যায়। এ কথার যুক্তি হিসেবে আজকের প্রবন্ধে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করা হলো। 

প্রথমত: মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের বিষয়ের উপর দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নতুন সংসদের যাত্রা শুরু হয় রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের মাধ্যমে। সংসদীয় ব্যবস্থায় এ বক্তব্যের ধরন হবে নির্দলীয়, নৈর্ব্যক্তিক, দেশ ও জাতির জন্য নির্দেশনামূলক, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের একাংশ জুড়ে ছিল বিরোধী দলসমূহের নির্বাচন বর্জনের কঠোর সমালোচনা। তিনি তাঁর বক্তব্যে বিরোধী দলসমূহের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি সংক্রান্ত আন্দোলনকে গণতন্ত্র বিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাকি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সকল পদক্ষেপ স্বার্থক হয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যের সরল অর্থ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো বিএনপিসহ বিরোধী দলসমূহের নিরপেক্ষ সরকারের অধীন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি গণতান্ত্রিক নয়। এছাড়া রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তব্যে আরো বলেছেন যে, ‘নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে’। 

অথচ বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক পণ্ড করার পর বিরোধী দলের উপর যে কি ধরনের হামলা-মামলা শুরু হয়েছিল যার ধারবাহিকতা এখনও বিদ্যমান তা সব জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে।

এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বসহ জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এবার বিরোধী দলের প্রসঙ্গে আসা যাক। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইজ্জত বাঁচাতে একটি বিরোধী দল দরকার তাই আসন সংখ্যা যাই হোক না কেন প্রচলিত রীতি-নীতির বাইরে জাতীয় পার্টিকে বরাবরের মতো নামে মাত্র বিরোধী দল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দ্বাদশ সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্য ছিল অনেকটা শংকিত কণ্ঠে। যারা বিটিভিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখেছেন এ বিষয়টি সহজেই বুঝতে পেরেছেন। বিরোধী দলীয় নেতা জনাব জিএম কাদের স্পীকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তব্যে কিছুটা হলেও বিরোধী দলীয় নেতার অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন। এতদসত্ত্বেও টেলিভিশনে বক্তব্যকালীন বিরোধী দলের উপনেতার বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে মনে হয়েছে তিনি এমন বক্তব্যে বিব্রতবোধ করছেন। কারণ তারা মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধানের বদন্যতায় সংসদ সদস্য হয়েছেন এ দুর্বলতা মানসিকভাবে তাদের মধ্যে কাজ করছে এবং সর্বদা করবে। অবাক ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তার প্রতিক্রিয়ায় এতটুকু বিরোধী বক্তব্যও মেনে নিতে পারেননি। 

এবার স্বতন্ত্র সদস্যদের প্রসঙ্গে আসা যাক। সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষায় স্বতন্ত্র সদস্য বলতে তাদের বুঝানো হয় যারা কোনো দলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন না। এমনও হতে পারে তারা ব্যক্তিগত জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নয়। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর পছন্দ মাফিক যে-কোনো সংসদীয় দলে যোগদান করতে পারেন বা স্বতন্ত্রও থাকতে পারেন। কিন্তু এবারকার দ্বাদশ সংসদের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা দলীয় ব্যানারে নির্বাচন না করলেও তারা মূলত: আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। দলীয় প্রধানের অনুমতি ও আশির্বাদ পুষ্ট হয়ে এলাকার আওয়ামী জনগণের ভোটেই তারা বিজয়ী হয়েছেন। যদি তারা কোনো সংসদীয় দলে যোগদান না করেন, তাহলে সংসদে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা পালনের সাংবিধানিক অধিকার তারা ধারণ করেন। কিন্তু নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত স্বতন্ত্র সদস্যদের কর্মকাণ্ড দেখে যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, তারা কোনো অবস্থাতেই সংসদে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন না। তারা কি পারবেন বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে, তারা কি পারবেন বেআইনীভাবে গ্রেফতার ও রাজনৈতিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে, তারা কি পারবেন সরকার দলীয় লোকদের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে, floor crossing এর ভয় না থাকা সত্ত্বেও তারা কি পারবেন সরকার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে? এটা দিবালোকের মতো সত্য, তারা কখনই এই অধিকার চর্চা করতে পারবেন না। কারণ সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য হলেও বাস্তব জীবনে তারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, দলীয় নেত্রীর প্রতি সম্পূর্ণভাবে আনুগত্যশীল। তারা দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করলেও তাদের দলীয় পদ এখনও বহাল আছে। কি এক বিচিত্র গণতান্ত্রিক চর্চা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে মনে হয় এটাই প্রথম ঘটনা যে স্বতন্ত্র সদস্যদের করণীয় কী হবে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান তা নির্ধারণ করে দেন। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন সরকার দলীয় প্রধানের আহ্বানে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জনৈক সদস্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন ‘সংসদে আমরা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই’। অন্যান্য সদস্যরাও অনুরুপ বক্তব্য দিয়েছেন। উক্ত বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সবই তাঁর- একটা ডান হাত, অন্যটা বাম হাত’। বলা যায়, এ-টিম ও বি-টিম। 

এছাড়া সংসদে সংরক্ষিত আসনে তাদের পক্ষে মহিলা সদস্য কারা হবেন তার মনোনয়নের দায়ভারও সরকার দলীয় প্রধানের হাতে তারা সমর্পণ করেছেন। জাতীয় সংসদ (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন) নির্বাচন আইন ২০০৪ অনুযায়ী প্রত্যেক সংসদ সদস্য তার পছন্দ অনুযায়ী সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। আপনি কি মনে করেন, সরকার দলীয় প্রধানের মনোনীত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দ কোনো কিছু বলা ও না বলার অধিকার কারো আছে? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র সদস্যদের স্বতন্ত্র হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মানে, তাদেরকে তাদের ইচ্ছা মাফিক সংসদীয় দলে তথা আওয়ামী লীগে যোগদানের অনুমতি দেননি। এমতাবস্থায় তারা সংসদে সরকারের পক্ষে/বিপক্ষে উভয়ই ভূমিকা পালন করতে পারবেন। এখন প্রশ্ন হলো, যারা দলীয় প্রধানের অনুমতি নিয়ে দলীয় সমর্থকদের ভোটে নির্বাচিত, যাদের দলীয় পদ-পদবী এখনও বহাল তাদের পক্ষে কখনই কি নিরপেক্ষ বা বিরোধী ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে? বিরোধী অবস্থানের কারণে কোন ক্ষেত্রে floor crossing এর সাংবিধানিক দায় এড়াতে পারলেও দলীয় লোকদের মার (একটু খোলাভাবে বলার জন্য দুঃখিত) এড়াতে পারবেন? কেউ কি বিরোধী ভূমিকা পালনের এমন দুঃসাহস দেখাবেন যার জন্য পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার মৃত্যু ঘণ্টা বাজবে। কখনই না। তাহলে দ্বাদশ সংসদ আগামী দিনগুলোতে কেমন সংসদ হবে, সহজেই অনুমান করা যায়। তাই সতত সিদ্ধভাবে বলা যায়- ‘দ্বাদশ সংসদের এ যাত্রা গণতন্ত্রের আশা-আকাংখার প্রতীক হিসেবে নয়, এ এক সম্ভাব্য গণতন্ত্রহীন সংসদের যাত্রা’। দ্বাদশ সংসদের চিত্র দেখলে হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতার পংক্তি মনে পড়ে ‘এটম বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা শুধু ক্ষমতাই বুঝল, দেশের মানুষের আশা-আকাংখার প্রতীক গণতন্ত্র বুঝল না। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d