USA

নাইট্রোজেন গ্যাস প্রয়োগসহ যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতিগুলো কতটা মানবিক

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে দণ্ড কার্যকরের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। কীভাবে অপেক্ষাকৃত ‘মানবিক’ কায়দায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডকে ‘যন্ত্রণাহীন’ করার চেষ্টায় নতুন নতুন পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে প্রথমবারের মতো নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তবে ‘ব্যথামুক্ত ও মানবিক’ বলে দাবি করা এসব পদ্ধতি আদৌ মানবিক কি না, তা নিয়ে বারবারই প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বড় অংশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। পরে বৈদ্যুতিক শক, ফায়ারিং স্কোয়াড, গ্যাস চেম্বার, প্রাণঘাতী ইনজেকশনের মতো বিভিন্ন পদ্ধতি চালু হয়। তবে অঙ্গরাজ্যভেদে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতিতে ভিন্নতা আছে।

ফাঁসিতে ঝোলানো

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অলাভজনক সংস্থা ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টার মৃত্যুদণ্ডসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করে। সংস্থাটি বলছে, ১৮৯০-এর দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মূলত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। ডেলাওয়ার ও ওয়াশিংটনে এখনো ফাঁসি দেওয়ার অনুমতি আছে। তবে এখন এ অঙ্গরাজ্যগুলো প্রধানত প্রাণঘাতী ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে থাকে। ডেলাওয়ারে সর্বশেষ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৯৬ সালের ২৫ জানুয়ারি।

ফাঁসিতে ঝোলানোর আগের দিন আসামির ওজন মাপা হয়ে থাকে। এরপর একই ওজনের বালুভর্তি ব্যাগ ব্যবহার করে ফাঁসি কার্যকরের মহড়া চালানো হয়। মূলত ফাঁসির দড়ির দৈর্ঘ্য কতটুকু রাখতে হবে, তা নির্ধারণ করাটাই এ মহড়ার উদ্দেশ্য। দড়ি বেশি ছোট হয়ে গেলে আসামির শ্বাস রোধ হতে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত অর্থাৎ, দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।

ফাঁসিতে ঝোলানোর আগমুহূর্তে আসামির হাত ও পা বেঁধে ফেলা হয়। তাঁর চোখগুলোও কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ফাঁসি কার্যকরের সময় আসামির পায়ের নিচে থাকা পাটাতনটি সরে যায় এবং তিনি পাটাতনের নিচে থাকা গর্তে পড়ে যান।

ফায়ারিং স্কোয়াড

যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি, ওকলাহোমা, ইউটা, সাউথ ক্যারোলাইনা, আইডাহো—এসব অঙ্গরাজ্যে এখনো ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমতি আছে। তবে প্রাণঘাতী ইনজেকশন ব্যবহার না করা গেলেই কেবল এসব অঙ্গরাজ্যে এ পদ্ধতি অবলম্বনের সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ পদ্ধতিতে সর্বশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা ঘটেছে ২০১০ সালের ১৭ জুন, ইউটাতে। রনি গার্ডেনার নামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির নিজের ইচ্ছায় তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দেওয়া হয়।

এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে চামড়ার তৈরি ফিতা দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। চেয়ারের চারপাশে কিছু বালুর বস্তা রেখে দেওয়া হয়। একজন চিকিৎসক স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে আসামির হৃৎপিণ্ড শনাক্ত করেন এবং সেটি বরাবর একটি গোলাকৃতির সাদা কাপড় লাগিয়ে দেন।

ওই ব্যক্তির থেকে ২০ ফুট দূরে ৫ ব্যক্তি রাইফেল নিয়ে অবস্থান নেন। রাইফেলগুলোতে একটি করে গুলি থাকে। একটি রাইফেলে কোনো গুলি থাকে না। এরপর ওই বন্দুকধারীরা ওই আসামির বুকে গুলি করেন।

তবে ভুলবশত গুলি যদি ওই ব্যক্তির হৃৎপিণ্ডে না লাগে, তবে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হতে অনেক সময় লেগে যায়।

গ্যাস চেম্বার

কীভাবে অপেক্ষাকৃত মানবিক উপায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে ভাবছিল নেভাদা অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে ১৯২৪ সালে অঙ্গরাজ্যটিতে সর্বপ্রথম সায়ানাইড গ্যাস ব্যবহার করে জি জন নামের এক আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জন ঘুমানোর সময় তাঁর কারাকক্ষে সায়ানাইড গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চেয়েছিল অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষ। তবে তা সম্ভব ছিল না। কারণ, এভাবে ওই কারাকক্ষ থেকে অন্য জায়গায় গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় গ্যাস চেম্বার (বাতাস ঢোকা বা বের হওয়ার সুযোগ নেই এমন কক্ষ) তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।

সায়ানাইড গ্যাস প্রয়োগ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আসামিকে ওই চেম্বারে নিয়ে একটি চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। ওই চেয়ারের নিচে সালফিউরিক অ্যাসিড–ভর্তি একটি পাত্র রেখে দেওয়া হয়। আসামির শরীরের সঙ্গে লম্বা একটি স্টেথোস্কোপ যুক্ত থাকে, যেন চেম্বারের বাইরে থেকে চিকিৎসক তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেন। সবকিছু প্রস্তুত হওয়ার পর শুধু আসামিকে রেখে অন্যরা কক্ষটি থেকে বের হয়ে আসেন এবং কক্ষটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। এরপর জল্লাদকে সংকেত দেওয়া হলে তিনি একটি দণ্ড নাড়াতে থাকেন। তখন ওই কক্ষে সোডিয়াম সায়ানাইডের স্ফটিক বের হয়ে পাত্রে রাখা সালফিউরিক অ্যাসিডের সঙ্গে মিশে যায় ও রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস।

যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ। তখন অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে ওয়াল্টার লা গ্রান্দ নামের এক জার্মান নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।

ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে বলা হয় ইলেক্ট্রোকশন পদ্ধতি

ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে বলা হয় ইলেক্ট্রোকশন পদ্ধতি

ইলেক্ট্রোকশন বা বৈদ্যুতিক শক

ফাঁসির চেয়ে তুলনামূলক মানবিক মৃত্যুদণ্ড পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টায় সর্বপ্রথম নিউইয়র্কে ইলেকট্রিক চেয়ার তৈরি করা হয়। ১৮৯০ সালে ওই চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মধ্য দিয়ে উইলিয়াম কেমলার নামের একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোও এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করে। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অঙ্গরাজ্যেই এটিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। একসময় নেব্রাস্কাতে এটি একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অঙ্গরাজ্যটির সর্বোচ্চ আদালত এ পদ্ধতিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার পর নেব্রাস্কা বিকল্প পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করে।

ইলেক্ট্রোকশন পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য আসামিকে ইলেকট্রিক চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। আসামির পায়ের দিকেও একটি বিদ্যুৎ পরিবাহী যন্ত্র বসানো থাকে। পরে এগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

নাইট্রোজেন গ্যাস প্রয়োগ

যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে ২০১৫ সালে প্রথমবারে মতো নাইট্রোজেন গ্যাস প্রয়োগ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়া হয়। বলা হয়, প্রাণঘাতী ইনজেকশন ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে। এরপর আলাবামা ও মিসিসিপিতেও এ পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে ওকলাহোমা প্রথম অনুমোদনকারী হলেও প্রথম এ পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছে আলাবামা অঙ্গরাজ্যে। সম্প্রতি সেখানে কেনেথ স্মিথ নামের এক আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে আসামির মুখে একটি রেসপিরেটর মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই মাস্কের মাধ্যমে আসামির ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ না করে শুধু নাইট্রোজেন গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী ইনজেকশন পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমোদন আছে

এখন যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী ইনজেকশন পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমোদন আছে

প্রাণঘাতী ইনজেকশন প্রয়োগ

সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে প্রাণঘাতী ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে এ প্রক্রিয়ায় প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় টেক্সাসে, ১৯৮২ সালের ২ ডিসেম্বর। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী ইনজেকশন পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমোদন আছে।

প্রক্রিয়াগুলো কতটা মানবিক?

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করে ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক রবার্ট ডুনহাম বলেন, ‘যখন কেউ মৃত্যুদণ্ডের নতুন পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দেন, তখন তিনি একই যুক্তি দেখান, তা হলো “বিশ্বাস করুন, এটা দ্রুত কাজ করবে। এটা হবে ব্যথাহীন। এটা হবে সবচেয়ে মানবিক প্রক্রিয়া।” এ ক্ষেত্রে তাঁদের রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকে। বাস্তবে তাঁরা নিজেদের দাবিকে সমর্থনের জন্য চিকিৎসাবিষয়ক কিংবা বৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণা করেন না। আর সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আজ অথবা কাল তা ভুল বলে প্রমাণিত হয়, যা তাঁরা ধারণাও করতে পারেন না।’

২০১৫ সালে দেওয়া এক রুলে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যামুয়েল আলিটো বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যেকোনো পদ্ধতির মধ্যেই কিছুটা হলেও যন্ত্রণা হওয়ার ঝুঁকিটা থেকে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতাকারীদের অনেকে বলে থাকেন, ‘মানবিক উপায়’ ও ‘মৃত্যুদণ্ড’ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। এটা সম্ভব নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d