নাটকীয় যুদ্ধবিরতি ঘোষণাকে ঘিরে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন— এমনকি তার কিছু শীর্ষ সহকারীকেও — যখন তিনি গভীর রাতে সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেন যে ইসরাইল ও ইরান ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ শেষ করতে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। ট্রাম্পের আত্মপ্রশংসামূলক পোস্টের কয়েক ঘণ্টা পর পর্যন্তও ইসরাইলি সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সেই সময়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বেয়ার শেভা শহরে পড়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে চলছিল।
শেষ পর্যন্ত সকাল নাগাদ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরান থেকে ছোড়া দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের উত্তরের বাসিন্দাদের আবারও বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাতে বাধ্য করে। এর জবাবে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেন, আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) জোরালো প্রতিশোধ নেবে এবং তেহরানের কেন্দ্রে শাসকগোষ্ঠীর টার্গেটগুলোর ওপর শক্তিশালী হামলার প্রতিশ্রুতি দেন।
অতএব, এই যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ এবং ইসরাইল, ইরান ও আঞ্চলিক অন্যান্য শক্তিগুলোর ওপর এর প্রভাব নিয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এখানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরা হলো, যেগুলো আগামী দিনের বাস্তবতা নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।
১. যুদ্ধবিরতির নির্ভুল শর্তগুলো কী?
আগে আন্তর্জাতিক আলোচনা মানে ছিল অভিজ্ঞ কূটনীতিক ও আইনজীবী প্রণীত দলিল। সেই যুগ শেষ। যেমন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির চুক্তি সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পই ঘোষণা দেন। এখানেও তাই হয়েছে। ট্রাম্পের বর্ণনা ছিল সরল— উভয় পক্ষ গুলি ছোড়া বন্ধ করবে, যুদ্ধ শেষ। তবে আমরা জানি, তিনি এই পোস্ট দেওয়ার আগে ওয়াশিংটন ও জেরুজালেমের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলেছে। পাশাপাশি, কাতার সরকার হোয়াইট হাউস ও তেহরানের মধ্যস্থতা করেছে। এই আলোচনার প্রকৃত বিষয়বস্তু এখনো গোপন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে? কাতার ইরানকে কী দিয়েছে? কোনো পক্ষ কি ভবিষ্যতে নিজেদের আচরণ সীমিত করতে সম্মত হয়েছে? যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হলে প্রতিশোধের কোনো সীমা নির্ধারণ হয়েছে? ইরান কি তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো ছাড় দিয়েছে? এসব প্রশ্ন এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছে। ট্রাম্প বলেছেন, এই যুদ্ধবিরতি চিরদিন চলবে এবং ইসরাইল-ইরান আর কখনো যুদ্ধ করবে না। কিন্তু শর্তাবলী না জেনে তার এই দাবি সন্দেহজনকই বলা চলে।
২. ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষতি কতটা?
ইসরাইল যুদ্ধ শুরু করে মূলত এক লক্ষ্য নিয়ে— ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি রুখে দেওয়া। এই উদ্দেশ্যেই ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম আঘাত, এরপর পারমাণবিক স্থাপনায় নিখুঁত হামলা এবং পরে ট্রাম্পের নির্দেশে ফরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হয়। তবে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে এসব স্থাপনার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং সেগুলো পুনর্গঠনে ইরানের কত সময় লাগবে। ইরান দাবি করেছে, ফরদোর স্থাপনায় কেবল সামান্য ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়েছে। এই দুই দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাই সাবধানতা অবলম্বন করাই ভালো। পারমাণবিক পর্যবেক্ষক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতি হয়েছে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যদি কোনো উপাদান রক্ষা পেয়ে থাকে এবং ইরান তা ব্যবহার করে পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেয়, তবে শান্তির সময়সীমা হয়তো খুবই অল্প হবে।
৩. ইরানের ৬০ ভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায়?
এই প্রশ্নটি আগের প্রশ্নের সরাসরি ধারাবাহিকতা। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণের আগেই কিছু ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে উভয় পক্ষ এবং ইরানই দাবি করেছে। কিন্তু কতটা সরানো হয়েছে এবং তা কোথায় রাখা হয়েছে — সেটি এখনো অজানা। ইরান রক্ষা পাওয়া ইউরেনিয়ামকে বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইবে। অন্যদিকে, নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের জন্য এটি একটি কৌশলগত বিপদ। কারণ, যদি স্বীকার করতে হয় যে ইউরেনিয়াম ধ্বংস হয়নি, তাহলে তাদের বিজয় ঘোষণার ভিত্তিই ভেঙে পড়বে। ইসরাইল ইরানের ভেতরে গোয়েন্দা অভিযান চালিয়ে এসব তথ্য জানার চেষ্টা করবে— এমনকি ইউরেনিয়াম জব্দ বা ধ্বংসও করতে পারে। এতে আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
৪. যুদ্ধবিরতিতে ইয়েমেনের হুতিরাও কি অন্তর্ভুক্ত?
১২ দিনের ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে হুতিরা বেশিরভাগ সময় নিষ্ক্রিয় ছিল। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ব্যবহার করতে হয়নি, কারণ ইরানই পুরো ইসরাইলের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। তবে এখন যুদ্ধ শেষ হলেও গাজার যুদ্ধ চলছেই। তাই প্রশ্ন উঠেছে— ইয়েমেন থেকে আবারও ক্ষেপণাস্ত্র আসবে কি না। হুতিরা, যদিও ইসরাইলের সবচেয়ে দুর্বল শত্রু, গত ২০ মাসে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। এলাত বন্দর বন্ধ করে দিয়েছে, বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার পর অনেক বিদেশি বিমান সংস্থা সরে গেছে। তাই হুতিরা এই যুদ্ধবিরতির অংশ কি না— এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতির কথা মাথায় রেখে।
৫. গাজার যুদ্ধের ওপর কী প্রভাব পড়বে?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্ভবত এটি। ইরান ফ্রন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও, এখন ইসরাইল পুরোপুরি গাজার দিকে মনোযোগ দেবে, যেখানে হামাস এখনো ৫০ জন জিম্মি ধরে রেখেছে— যাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত বলে ধারণা। ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুর কাছ থেকে গাজায় যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন ইরান হামলার অনুমতির বিনিময়ে? ইসরাইল কি অবশেষে তাদের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করতে রাজি হবে?
একটি তত্ত্ব হলো— ইরানের দুর্বলতা দেখে হামাস আরও নমনীয় হবে। কিন্তু জিম্মিদের পরিবারের মধ্যে এক ভয় আছে— তারা আশঙ্কা করছে, আমেরিকা-ইসরাইল মিলে যেভাবে ইরানকে ফাঁকি দিয়েছে, তা দেখে হামাস আরও অবিশ্বাসী হয়ে পড়বে।
মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের জীবন এখন অনিশ্চয়তার মাঝে ঝুলে আছে।