Bangladesh

নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত ফার্স্ট ফাইন্যান্সের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং খেলাপি ঋণে জড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এবার পর্ষদের কাউকে বাদ না দিয়ে বসানো হচ্ছে নতুন আরও ৫ স্বতন্ত্র পরিচালক। আর নতুনরাই সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এতে পুরোনো এবং বিভিন্ন অপরাধে জড়িতরা ঋণ আদায়ে সহায়তা করবেন। যাদের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) আবুল কালাম মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। বিএসইসির কমিশন মিটিংয়ে আজ এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ একজন বর্তমানে এ কোম্পানির অন্যতম পরিচালক। বাজারে এটি একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের সম্পদের চেয়ে দায় ২৪৬ কোটি টাকা বেশি। সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৮৭ শতাংশই খেলাপি। সম্মিলিত লোকসান ৩২৫ কোটি টাকা। ১৪ বছরে বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাজারের জন্য দায়।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম মঙ্গলবার বলেন, কোনো কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে কি না, সুনির্দিষ্টভাবে আমার জানা নেই। তবে কোনো কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি, আইন লঙ্ঘন বা অনিয়ম করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে কমিশন। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সূত্র জানায়, ৩ বছরে নামসর্বস্ব ২৬টি প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করেছে বিএসইসি। এর মধ্যে ব্যাংক, বিমা এবং লিজিং কোম্পানিও রয়েছে। তবে এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। কারণ, বাইরে থেকে কেউ এসে কোম্পানি চালানো কঠিন। ফলে পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পর কিছু কোম্পানি আরও দুর্বল হয়েছে। এটাকে পুঁজি করে সেকেন্ডারি মার্কেটে কারসাজি করে একটি পক্ষ। তাই এবার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমান পর্ষদ রেখেই নতুন করে ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালক দেবে কমিশন। তবে সেক্ষেত্রে আইনের কিছুটা জটিলতা রয়েছে। বিদ্যমান আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হতে পারেন ৯ থেকে ১১ জন। কিন্তু নতুন করে পাঁচজন পরিচালক দেওয়া হলে আইনি সীমা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিএসইসি চাইলে সিকিউরিটিজ আইনের আওতায় বিশেষ সার্কুলার দিয়ে এটি করতে পারে। এছাড়া কমিশন চাইলে কাউকে বাদও দিতে পারে। প্রাথমিকভাবে কমিশন সবাইকে রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পুরো বিষয়টি আজকের কমিশন সভায় চূড়ান্ত হবে।

নতুন করে যাদের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে বাকি চারজন হলেন আইটি উদ্যোক্তা সিএসএল সফটওয়্যার রিসোর্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রওলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাজী মইন উদ্দিন মাহমুদ ও খোন্দকার নিজাম উদ্দিন।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক কার্যক্রম অনিয়মিত। ২০০৩ সালে এ কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ সময়ে বাজার থেকে ৫ কোটি টাকা নেয়। এর মধ্যে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ২ কোটি এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আইপিওর মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৪ কোটি টাকা লিজ অর্থায়ন, ৬৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা মেয়াদি অর্থায়ন এবং ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আইপিওতে খরচ বাবদ ব্যয় করার কথা ছিল। এরপর ১৫ বছর বোনাস শেয়ার ঘোষণা এবং ২০১৩ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১১৮ টাকায় উন্নীত করা হয়। কমিশন বলছে, নিয়মানুসারে জেড ক্যাটাগরিতে লেনদেন শুরুর ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করতে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি কোম্পানিটি। এ কারণেই পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জে কিবরিয়া অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিষ্ঠানটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ১৪ দশমিক ৫২ টাকা। আর প্রতি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ লোকসান ২৮ দশমিক ৮৪ পয়সা। সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন রুগ্ণ হয়ে আছে। ১৪ বছরে বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ৫০০ কোটি অনুমোদিত মূলধনের এই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তাদের ৪১ দশমিক ৩১, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০ দশমিক ৮৩ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানির মোট সম্পদ ৯৫৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর মোট দায় ১ হাজার ১৯৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির সম্পদের চেয়ে দায় ২৪৬ কোটি ৫ লাখ টাকা বেশি। কোম্পানির সর্বশেষ খেলাপি ঋণ ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। শতকরা হিসাবে মোট ঋণের ৮৭ শতাংশ। কোম্পানির সম্মিলিত লোকসান ৩২৫ কোটি টাকা এবং শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি ১৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা নেতিবাচক। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটির রিজার্ভ ৪৬০ কোটি টাকা নেতিবাচক। বর্তমানে ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ার ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ইস্যু ম্যানেজার ছিল প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। আইপিও প্রতিবেদন তৈরির সময় কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এম জে আবেদীন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ একজন বর্তমানে এ কোম্পানির অন্যতম পরিচালক। তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে।

বর্তমানে কোম্পানির ৯ জন পরিচালকের মধ্যে রয়েছেন চেয়ারম্যান খান মোহাম্মদ মইনুল, দুই ভাইস চেয়ারম্যান মাসুদ হোসেন খান ও আবু জাকির। পরিচালক হিসাবে রয়েছেন একিউএম ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, আমাতুন নুর, রামিতোন রেজা, মো. আলতাফ হোসেন, স্বতন্ত্র পরিচালক হাবিবুর রহমান, সুলতান আহমেদ ভুইয়া এবং ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুমুল মাহমুদ। জানতে চাইলে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুমুল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে এখনো আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি। আর্থিক প্রতিবেদন ও খেলাপি ঋণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আর্থিক প্রতিবেদন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর এ ব্যাপারে বলা যাবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button