Trending

নানা উদ্যোগের পরও রিজার্ভ কমছে

ডলারের সংকটের মধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মজুত বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কাজ হচ্ছে না। উল্টো কমছে রিজার্ভ। রমজান ও আসন্ন ঈদ ঘিরে গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্সে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু রিজার্ভের মজুত বাড়ানো যাচ্ছে না। বাড়লেও এর প্রভাব খুবই সামান্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারো রমজানের শুরু থেকেই প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার এসেছে। মাস শেষে ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ সবশেষ বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছর ডিসেম্বর শেষে তা ছিল ২১.৮৭ বিলিয়ন ডলার। 
তথ্য অনুযায়ী, বিপিএম-৬ অনুযায়ী গত ৬ই মার্চ রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার।

বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৪৫ কোটি ডলারে। 

অপরদিকে গত ৬ই মার্চ গ্রোস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৩৪ কোটি ডলার। ২৭শে মার্চ এ রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৮১ কোটি ডলারে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১৫২ কোটি ডলার।
এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। প্রতি মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য বাংলাদেশের জন্য।

সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।
সূত্র জানায়, রিজার্ভ বাড়াতে আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করাসহ ভবিষ্যতে আমদানির গতি স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক নীতি পরিবর্তনে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক মহলসহ সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ ডলার সংকট কাটাতে চলতি বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে কারেন্সি সোয়াপ কার্যক্রম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আওতায় প্রায় ১৭৫ কোটি ডলার রেখে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি তারল্য সহায়তা নিয়েছে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক। জমা রাখা ডলার বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভে যোগ হচ্ছে। এর মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়াতে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু একদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ এবং অপরদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ। আবার আমদানির জন্য এলসি খুলতে বিপুল অঙ্কের ডলারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফলে রিজার্ভ যতটুকু বাড়ছে তার চেয়ে বেশি কমছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আপাতত ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশে ধরে রাখতে চায় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে নিট রিজার্ভ এ অঙ্কের কাছাকাছি অবস্থান করেছে। 

এদিকে রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বকেয়া রপ্তানি আয় দেশে আনা ও বেশি দামে হলেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ বাড়ানোর তাগিদও দিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে যাতে আমদানি ব্যয় বেশি না বাড়ে সেজন্য আমদানিতে জোরেশোরে লাগাম টানা হয়েছে। অন্যান্য খাতেও ডলার সাশ্রয় করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

সূত্র জানায়, আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী গত বছরের জুনে নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ডলার। ওই সময় নানামুখী চেষ্টা করেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিজার্ভ রাখতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জুনে নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫৬ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশ কম। রিজার্ভ নিম্নমুখী হওয়াতে আইএমএফ তা কমিয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। সে অনুযায়ী জুনে গ্রস রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ডলার। নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। কিছুদিন রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। এখন আবার কমেছে। এ ছাড়া জুনের আগে আরও তিনটি বড় দেনা পরিশোধ করতে হবে।
এর মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনার দুটি কিস্তি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ধার করা ডলার পরিশোধ করতে হবে। মার্চ ও এপ্রিলের আকুর দেনা পরিশোধ করতে হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। মে ও জুনের দেনা শোধ করতে হবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। এই দুই খাতের দেনা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দেনা বাবদ শোধ করা হয়েছে ১২৯ কোটি ডলার। ফলে আমদানি যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু দেনা শোধের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। 

এদিকে আমদানির এলসি খোলায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলারে নেমে আসে। কিন্তু জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানির দায় পরিশোধও বাড়ছে। এতে আগামীতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার আগে যেখানে ৩০ শতাংশ কমেছিল, এখন তা বাড়তে শুরু করেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি, চিকিৎসা উপকরণসহ নানা খাতে আমদানিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব খাতে আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। এসব কারণে রিজার্ভ বাড়ানোটা চ্যালেঞ্জিং।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমছে। সবশেষ তথ্য মতে, মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৪.৮৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ অনুযায়ী তা ১৯.৫০ বিলিয়ন ডলার। আয়-দায় বাদ দিলে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ আছে ১৪.৪৩ বিলিয়ন ডলার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মোট রিজার্ভ ছিল ২৫.৯৭ বিলিয়ন ও বিপিএমে ২০.৭৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগের মাস জানুয়ারিতে আকু বিল পরিশোধে একটু টান পড়ে মোট রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৫.১১ বিলিয়ন ও বিপিএম হিসাবে ছিল ১৯.৯৭ বিলিয়ন। ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিল ২৭.১৩ বিলিয়ন ডলার ও বিপিএমে ২১.৮৭ বিলিয়ন, নভেম্বরে ছিল ২৪.৮৯ বিলিয়ন ও বিপিএম হিসাবে ১৯.৩০ বিলিয়ন, অক্টোবরে ছিল ২৬.৪৮ বিলিয়ন ও বিপিএমে ২০.৭১ বিলিয়ন। সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ ছিল ২৬.৯১ বিলিয়ন ডলার ও বিপিএম হিসাবে ২১ বিলিয়ন, আগস্টে ছিল ২৯.২৬ বিলিয়ন ও আইএমএফের হিসাবে ২৩.২৬ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টের রেকর্ড রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার। তখন বিপিএম হিসাবে দেখানো হতো না। 

এদিকে রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়ে আইএমএফ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। তাদের শর্ত অনুযায়ী ২০২৫ সালের জুনে নিট রিজার্ভ রাখতে হবে ২ হাজার ৫৯৩ কোটি ডলার। গ্রস রাখতে হবে ৩ হাজার ১৩ কোটি ডলার। ২০২৬ সালের জুনে নিট রিজার্ভ ৩ হাজার ৪৫৩ কোটি ডলার ও গ্রস রিজার্ভ ৩ হাজার ৮৭৩ কোটি ডলার রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ডলার-সংকট সামলাতে নানা উদ্যোগের ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স বেড়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্স সরাসরি রিজার্ভে যোগ হয় না। আবার অন্যান্য খাতের কিছু নেতিবাচক প্রভাবে রিজার্ভ না বেড়ে উল্টো কমছে। সামনে রিজার্ভ বাড়বে। এই নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমেছিল। তবে ডলারের দামে এখনো বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত দর হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১০ টাকা। কিন্তু এই দামে বেশির ভাগ ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব ডলারের জোগান দিচ্ছে শুধু সেগুলোই ১১০ টাকা করে কিনতে পারছেন আমদানিকারকরা। এর বাইরে অন্য কোনো ডলার এই দামে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পাওয়া গেলেও কিনতে হচ্ছে ১১৬ থেকে ১২৪ টাকা দরে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button