Trending

নাব্যতা সঙ্কট আর বর্জ্যে ইলিশের বিচরণস্থল নাগালের বাইরে, ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা বাংলাদেশের নৌ-সীমায়

জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ক্রমাগত নাব্যতা সঙ্কট বৃদ্ধি এবং অবাধে শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল ও সংলগ্ন উপকূলভাগে ইলিশের বিচরণ ক্রমাগত পূর্ব-দক্ষিণ উপকূলে সরে যাচ্ছে। সাথে আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমার অভ্যন্তরে ভারতীয় জেলেদের অবাধ মৎস্য আহরণ মৎস্য সম্পদের ওপর আরো বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অতি নিকট অতীতেও বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলভাগে যেখানে ৬৮-৭০ ভাগ ইলিশ আহরণ হতো, গত কয়েক মাসে তা প্রায় অর্ধেকের মতো হ্রাস পেয়েছে।

একইসাথে বিগত গ্রীস্ম মৌসুমে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহ ও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির ব্যাপক ঘাটতির সাথে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ৩-৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস পাবার কারণেও ইলিশের বিচরেণস্থল পরিবর্তনসহ জেলেরা নদ-নদী ও সাগর উপকূলে নামতে না পারায় ইলিশ আহরণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এ দাবি মৎস্যজীবীদের।

এমনকি খুব সহসাই ইলিশের অবাধ ও সুস্থ বিচরণসহ প্রজনন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে না পারলে আগামীতে উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টির আশঙ্কার কথা বলেছেন একাধিক মৎস্য বিজ্ঞানী।
গত বছর ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের মূল প্রজনন মৌসুমের ২২ দিনের আহরণ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে দেশের ইলিশ প্রজন্মে আরো অন্তত ৪১ হাজার কোটি জাটকাযুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীগণ। যা পূর্ববর্তি বছরে ছিল ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি। বিগত মূল প্রজননকালীন সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় প্রজনন এলাকায় ৫২.০৪ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৫ ভাগ বেশি এবং আরো অন্তত ৩৫ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ারত ছিল বলে গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ইলিশ উৎপাদনের ক্রমবর্ধনশীল ধারায় এখনো খুব বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে বিরূপ পরিবেশ ও নানামুখি প্রাকৃতিক সমস্যা নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাদের মতে, মনুষ্য সৃষ্টি নানা কর্মকান্ডের সাথে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনে এবার ইলিশের বিচরণস্থলে নানামুখী বিরূপ প্রভাবে আবাস্থলের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চল সহ সংলগ্ন উপকূলভাগে এবার ইলিশের বিচরণ কম থাকায় আহরণও কিছুটা কম লক্ষ্যণীয়। ফলে বাজারে সরবরাহ ঘাটতির সাথে মূল্যও আকাশচুম্বি।

তবে এরমধ্যেও বিগত দুর্গা পূজার সময় বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ভারতে প্রায় ৪ হাজার টন ইলিশ রফতানি করা হয়েছে স্থানীয় বাজার দরের চেয়ে অনেকটাই কম মূল্যে। দেশের মানুষের জন্য সহনীয় মূল্যে ইলিশ সরবারহের লক্ষ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে ইলিশ রফতানি বন্ধ রয়েছে। কিন্তু আহরণ হ্রাসসহ বাজারে যোগান কম থাকায় বরিশালের খুচরা বাজারে এখন সাড়ে ৮শ’ গ্রাম থেকে ১ কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা কেজি। এরপর থেকে সাইজ যত বড়, দামও তত বেশি। তবে গত ১ নভেম্বর থেকে জাটকা নিধনে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বরিশাল সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে জাটকার অবাধ বিপনন অব্যাহত রয়েছে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশরাফুল আলম জানান, চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মোহনায় যে শ্রোত অতীতে ছিল বিগত বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবসহ উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে তা লক্ষ্য করা যায়নি। উপরন্তু চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শর’ও বেশি ডুবোচর সৃষ্টি হয়ে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশি সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না।

এমনকি শীত মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের প্রায় ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচে নেমে যাবার সাথে লাগাতার মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশায় জেলেরা সাগর ও নদ-নদীতে নামতে না পারায় সরবারহে ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে।
ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটো প্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটনের ঘাটতি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার প্রকটাকার ধারণ করেছে। যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্লাঙ্কটন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্লাঙ্কটন ১৫শর স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩শতে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগরের উপকূল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছে না।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সীমান্তের ওপর সহ উজানের সব নদ-নদীর প্রায় ৭০ ভাগ পানি মেঘনা ও এর শাখা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। কিন্ত সীমান্তের ওপারে নিয়ন্ত্রণে প্রবাহ যেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি শিল্প ও মনুষ্য বর্জের কারণে দুষণের মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশির গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ইলিশ সাগর থেকে নদী মুখি হচ্ছে না। ইলিশ বিচরণের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন, সেখানে বিগত গ্রীস্ম মৌসুমে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করে বলেও জানান তিনি।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন শ্রোতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলে উপকূলের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলামও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীদের সাথে একমত পোষণ করে ইলিশের বংশবিস্তার সহ নদ-নদীর হাইড্রো- মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারির আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমায় প্রতি বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ছাড়াও আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পড়ের ২২ দিন সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও ভারত ও মায়নমারের জেলেরা এসময়ে অবাধে আমাদের নৌসীমা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাবার অভিযোগ রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের পানিসীমায় শুধুমাত্র ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মৎস্য আাহরণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এ দুটি দেশের জেলেরাই আমাদের নিষিদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গোপসাগরে নৌসীমা অতিক্রম করে অবাধে মাছ লুটে নেয় বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এর বিজ্ঞানী ড. হাসনাত সহ অন্যান্য মৎস্য বিজ্ঞানীগণ ‘প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণার সময় পুনঃবিবেচনার’ ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন ইতোপূর্বে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d