নাশকতায় বিশাল অর্থ বিনিয়োগ, দাতাদের খোঁজ চলছে
নাশকতা চালিয়ে দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করেছে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা। দেশের তরুণ ব্যবসায়ী ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অর্থের জোগান দেওয়ার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কয়েকটি দেশ থেকেও পাঠানো হয়েছে অর্থ। নাশকতাকা- বাস্তবায়নের জন্য পাঠানো সেসব অর্থ মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে সমন্বয়ক ও বাস্তবায়নকারীরা। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী অর্থদাতা, সমন্বয়ক এবং বাস্তবায়নকারীদের খোঁজে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে নাশকতার ঘটনায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী এবং অর্থ জোগানদাতারা শনাক্ত হচ্ছে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী দীর্ঘদিন ধরেই নাশকতাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। সবশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক রূপ দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের জোগান দিয়েছে তারা।
নাশকতাকারীদের কাছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে অর্থ আসছিল। এমন অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে অর্থদাতা, সমন্বয়ক এবং বাস্তবায়নকারী অনেককে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বাকিদের গ্রেপ্তারে একাধিক টিম মাঠে রয়েছে।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে নাশকতার ঘটনায় বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে ইন্ধন দেওয়া হয়েছে। দেশের তরুণ ব্যবসায়ী ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নাশকতাকা-ে এসব অর্থের জোগান দিয়েছে। আন্দোলন-সংঘর্ষ চলাকালীন কেউ পানি সরবরাহ করেছে, কেউ খাবার সরবরাহ করেছে।
আহতদের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে এবং চিকিৎসার জন্য অর্থের বরাদ্দ ছিল। নাশকতা চালাতে বস্তির টোকাই ও ফুটপাতের হকারদের টাকার বিনিময়ে মাঠে নামানো হয়েছে। কয়েকটি দেশ থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের কাছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ এসেছে। তারা বাস্তবায়নকারীদের মাধ্যমে সেসব অর্থের কিছু অংশ ভাড়াটে সন্ত্রাসী, দাগি আসামি, রাজনৈতিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দেয়।
এদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এবং গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী অর্থের জোগানদাতাদের ধরতে গোয়েন্দা টিম মাঠে রয়েছে।
র্যাবের কাছে গ্রেপ্তার গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. তারেক রহমানের কাছেও কয়েক দফায় এসেছিল ১৬ লাখ টাকা। তার দায়িত্ব ছিল রামপুরা এবং বাড্ডা এলাকার বিষয়টি সমন্বয় করা। বিটিভি, রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন, বিজিবির এপিসি ভাঙচুরসহ অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে তার মাধ্যমে।
ফ্রান্সে থাকা একজন ইউটিউবারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। গ্রামের বাড়ি একই এলাকার হওয়ায় তারেকের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি ছিল ওই ব্যক্তির। আবার লন্ডনে থাকা বিএনপির এক শীর্ষ নেতাও তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভিডিওকলে কথা বলত। ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নূরের সঙ্গে তারেকের বিরোধের পর থেকে তাকে বেছে নেয় বিএনপিপন্থি নেতারা।
গত বুধবারও তার সঙ্গে বনানীর একটি অফিসে নাশকতা সংক্রান্তে বৈঠকও করেছিল বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা। আহত ব্যক্তিদের কম খরচে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর একটি নামকরা হাসপাতালে বলে রাখা হয়েছিল। ধ্বংসাত্মক কর্মকা- কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তৈরি করা হয়েছিল এ সংক্রান্ত নীলনকশা।
পাঁচটি দেশ থেকে বিভিন্ন ব্যানারে নিয়মিত অর্থ আসত বলে নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব থেকে আসা এসব অর্থের জোগানদাতাদের নামও তারা পেয়েছে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে এসব প্রবাসী বাংলাদেশী দীর্ঘদিন ধরেই নাশকতাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। বিএনপিপন্থি অন্তত ৩০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে নাশকতাকা- বাস্তবায়নের জন্য। গ্রেপ্তারকৃতরা ইতোমধ্যে ওই ব্যবসায়ীদের নাম ফাঁস করে দিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জনকণ্ঠেকে বলেন, তারেক রহমান ছাড়াও তার সহযোগী মো. সজল মিয়া, আল ফয়সাল রকি ও মো. আরিফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তারেক, সজল ও ফয়সাল রামপুরা-বাড্ডা এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। তারেকের কাছে ইউরোপের মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি দেশ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৬ লাখ টাকা এসেছে। এই তিনজন নওগাঁয় ছিল।
যখন আন্দোলন শুরু হয় তখন তারা আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ঢাকায় চলে আসে। তাদের কাছে আসা অর্থ দিয়ে সন্ত্রাসী, দাগি আসামি, ছিনতাইকারী, টোকাইদের ভাড়া করে নাশকতা চালায়। তখন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, ধ্বংসযজ্ঞের ছবি-ভিডিও ধারণ করে আর্কাইভে সংরক্ষণ করে রাখার। পরবর্তীতে নেট চালু হলে সেগুলো হাই কমান্ডে পাঠানোর। নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃতরা তাই করেছিল। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আরও অনেককে গ্রেপ্তারে র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও গোয়েন্দা টিম মাঠে রয়েছে।
অর্থদাতাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তা নাশকতাকা- বাস্তবায়নের জন্য ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দিত বিএনপির পৃষ্ঠপোষক ও মদতদাতা মো. আব্দুল আজিজ ওরফে সুলতান (৪৫)। বুধবার রাতে উত্তরখান থানাধীন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। আব্দুল আজিজ বগুড়ার যুবদল নেতা নুরে আলম সিদ্দিকি পিটনের দুলাভাই। যুক্তরাজ্য থেকে নুরে আলমের নির্দেশনা পেয়ে আব্দুল আজিজ ছাত্রদের মিছিলের ভেতর টাকার বিনিময়ে টোকাই ও ছিন্নমূল শ্রেণির লোকদের ঢুকিয়ে দিয়ে দেশব্যাপী হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ সূত্র জানায়, নুরে আলম যুক্তরাজ্য থেকে নির্দেশনা পায় পুলিশ মারলে ১০ হাজার এবং ছাত্রলীগ মারলে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর মাঠে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় তার দুলাভাই আব্দুল আজিজকে। আজিজ প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় রাজধানীর উত্তরা ও আব্দুল্লাহপুরসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বস্তির টোকাই ও হকারদের মাঠে নামায়।
যারা নাশকতাকা- বাস্তবায়নে অর্থ পৌঁছে দিয়ে ঢাকা শহরকে অকার্যকর করার দায়িত্ব নিয়েছিল তাদের মধ্যে সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সাইফুল ইসলাম নিরব, এস এম জাহাঙ্গীর, রফিকুল ইসলাম মজনু ও আমিনুল ইসলামসহ অসংখ্য জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের মোবাইল থেকে অনেক মেসেজ পাওয়া গেছে। এতে অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এবং দেশের বাইরে থেকে তাদের নির্দেশনা দিয়েছে যে, নতুন কমিটির দায়িত্ব তোমাদের দেওয়া হয়েছে, যদি নির্দেশনা না মানো তাহলে তোমাদের কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হবে।
সুলতানের মতো আরও কয়েকজন উত্তরা এলাকার নাশকতায় অর্থায়ন করেছেন। তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। এদিকে মহাখালী ও এর আশপাশের এলাকায় সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরসহ বেশকিছু জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করা হয়। এজন্য বনানী থানার এক জামায়াত নেতা কড়াইল বস্তির কিছু লোককে ভাড়া করেছিলেন বলে তথ্য পেয়েছে ডিবি। জামায়াতের ওই নেতা ঢাকার বাইরে গাঢাকা দিলেও তার অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে ডিবির একটি টিম। তাকে গ্রেপ্তারে ওই টিমের সদস্যরা অভিযানে গিয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তার করা গেলে মহাখালীতে আর কারা অর্থায়ন করেছিলেন- সে বিষয়ে তথ্য পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, কোটা আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় তা-ব চালায় নাশকতাকারীরা। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং মহাখালী ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। এসব এলাকায় সহিংসতার জন্য বস্তিবাসী, টোকাই এবং বিহারিদের ভাড়া করেন বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। রামপুরা এলাকায় তা-বের জন্য নুরের চেলা, ঘিরাপাড়া মসজিদ, বাঁশতলা এলাকা থেকে লোক ভাড়া করা হয়।
মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এলাকায় তা-ব চালায় ঢাকা উদ্যান এবং বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। যাত্রাবাড়ী এলাকায় নজিরবিহীন হামলায় অংশ নেয় জাপানি বাজার, সরাই, মেরাজনগর, জুরাইন এলাকার নি¤œ আয়ের লোকজন। স্থানীয় নেতারা এসব লোককে ভাড়া করে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সংঘর্ষ চলাকালে ছোট ছেলেরা এসে ঢিল ছুড়ছিল। তারা সবাই বিভিন্ন এলাকার বস্তির বাসিন্দা। তাদের কাছে তো এটা বিনোদনের মতো। যে মানুষ দিনে ১০০ টাকা কামায়, সে ঢিল ছুড়ে আর হামলা করে ১ হাজার টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কে কয়টা ঢিল ছুড়ল, এটা তো কেউ হিসাব করতে বসে থাকে না। প্রথমে তাদের এই টাকার লোভ দেখিয়ে মাঠে এনেছে, পরে তাদের হাতে হাজারখানেক টাকা দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। যারা টাকা দিয়েছে এবং যারা টাকা নিয়ে হামলা করেছে, তাদের সবাইকে শনাক্ত করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা নাশকতার ঘটনায় অর্থ জোগানদাতাদের নাম-পরিচয় জানাচ্ছে। গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বস্তি কেন্দ্রীক ছিন্মমূল মানুষকে, টোকাইকে বিএনপির নেতারা সংগঠিত করে আসছিল। এসকল মানুষকে টাকার বিনিময়ে মাঠে নেমে নাশকতা চালানোর নির্দেশ দেয় নেতারা।
নেশাদ্রব্য সেবন করে টোকাইরা সেভাবে হামলার পরবর্তী সময়ে লুটও করে। তবে গ্রেপ্তার বিএনপির একাধিক নেতা স্বীকার করে বলেছে, এভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ঠিক হয়নি। তারা টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, রাজনৈতিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ভাড়ায় আনলেও পরবর্তীতে তাদের কন্ট্রোল করা সম্ভব হয়নি। নিম্ন আয়ের এসকল মানুষ লুট করতে পরবর্তীতে নেতাদের নির্দেশনা মানেনি।