নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শত শত শিশু: রাজশাহীতে ৮৬ টাকার স্যালাইন ১২০০ টাকা
প্রতিটি শয্যায় চার থেকে ছয়টি শিশু * চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন
ঋতু পরিবর্তনকালে রাজশাহীতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। প্রতিদিন শতাধিক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডগুলোয় ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় এপিএন স্যালাইনের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় স্বজনরা চড়া দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ওষুধের দোকানে ৬৫ টাকার এপিএন স্যালাইন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের স্যালাইন পাওয়া গেলেও এপিএন স্যালাইনের হাহাকার চলছে।
রামেক হাসপাতালের ২৪নং ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে নাটোরের মাসুদ রানা কয়েকদিন ধরে অবস্থান করছেন। ৭ নভেম্বর হাসপাতালে তিনি সন্তানকে ভর্তি করান। হাসপাতালে স্যালাইন না থাকায় নগরীর লক্ষ্মীপুরের এক ফার্মেসি থেকে ৬৫ টাকার এপিএন স্যালাইন তিনি ৮০০ টাকায় কিনেছেন। চিকিৎসাধীন আরেক শিশুর বাবা সোলাইমান আলী জানান, এ স্যালাইন তিনি ১ হাজার ২০০ টাকায় কিনেছেন। তিনি আরও জানান, এপিএন, বেবি সল্টসহ আরও কিছু স্যালাইন চিকিৎসকরা লিখছেন। কিন্তু রাজশাহীতে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বেশি দাম দিতে চাইলে ফার্মেসির লোকেরা এনে দিচ্ছেন।
স্বজনরা আরও জানান, হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের উপচে পড়া ভিড় লেগে আছে। এ সুযোগে নগরীর লক্ষ্মীপুর ডাক্তারপট্টির ফার্মেসিগুলো স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কয়েকগুণ দাম আদায় করছে। এপিএন স্যালাইনের ৫০০ এমএল ব্যাগের গায়ে লেখা দাম মাত্র ৬৫ দশমিক ২৫ টাকা। আর ১০০০ এমএলের দাম ৮৬ দশমিক ৩২ টাকা। ডিএনএস-১০ স্যালাইনের দাম ৮০ টাকার মধ্যে। কিন্তু এসব স্যালাইন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এমন অরাজক পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নীরব থাকায় ভুক্তভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির রাজশাহী শাখার সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, নিউমোনিয়ার প্রতিরোধী এ ধরনের এক ব্যাগ স্যালাইনের সর্বোচ্চ দাম ১০০ টাকা হতে পারে। কিন্তু ১ হাজার ২০০ টাকা হবে-এটা খুবই অস্বাভাবিক। শিশু আক্রান্ত হওয়ায় হয়তো কিছু চাহিদা বেড়েছে। তবে কোম্পানিগুলো সরবরাহ বাড়াচ্ছে না। এ কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। ৬৫ টাকার স্যালাইন ১ হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
জানা যায়, হাসপাতালের শিশু বিভাগের কয়েকটি ওয়ার্ডে ২০০ শয্যা আছে। এর বিপরীতে প্রতিদিন শতাধিক আক্রান্ত শিশু ভর্তি হচ্ছে। প্রায় সবাই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। ডায়রিয়া আক্রান্ত কিছু শিশুও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সোমবার রামেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের ২৪নং ওয়ার্ডে দেখা যায়, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু ও স্বজনদের ভিড়ে ওয়ার্ডের ভেতরে ও বারান্দায় পা ফেলার জায়গা নেই। ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় শিশু রোগীদের সারি করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি শয্যায় চার থেকে ছয়টি করে শিশু রাখা হয়েছে।
চিকিৎসকরা জানান, কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু বেশি আসছে। তাদের বয়স শূন্য থেকে দুই বছর বা আড়াই বছর। অধিকাংশের চিকিৎসায় এপিএন স্যালাইন-৫০০ বেশি দরকার হচ্ছে। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় হাসপাতালে বেলি সল্ট জুনিয়র, বেলি সল্ট এ এপিএন স্যাল্যাইন সরবরাহ নেই। ডিএনএস স্যালাইনও নেই। দোকান থেকে অস্বাভাবিক বেশি দামে এসব স্যালাইন অভিভাবক ও স্বজনদের কিনতে হচ্ছে।
জানা যায়, শিশুদের প্রাণরক্ষাকারী স্যালাইন ঘিরে রাজশাহীতে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। অভিভাবকদের জিম্মি করে স্যালাইনের দাম প্রায় ২০০ গুণ বাড়িয়েছে কতিপয় ওষুধ ব্যবসায়ী। তবে স্যালাইন প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো দাম বাড়ায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রামেক হাসপাতালের এক শিশু চিকিৎসক বলেন, আবহাওয়া বদলের এ সময়ে শিশু ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় কতিপয় ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে স্যালাইনসহ ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তারা ১০০ টাকার স্যালাইন হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এটা আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু কিছু করার নেই।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালক ফাইসাল কবির চৌধুরী জানান, ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো এখন পর্যন্ত স্যালাইনের দাম বাড়ায়নি। কোনো ওষুধ বা স্যালাইনের দাম বাড়ালে সেটা গায়ে লেখা থাকত। কিন্তু খুচরা বাজারে এ চড়া মূল্য কেন, তা আমার জানা নেই। যারা এভাবে মানুষকে জিম্মি করে কয়েকগুণ দামে স্যালাইন ক্রেতাদের কিনতে বাধ্য করছে, তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. শাহিদা ইয়াসমিন জানান, প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৩০ জন করে শিশু ভর্তি হচ্ছে। শনিবার ১৮৪ জন ভর্তি হয়েছে। অক্টোবরে ১ হাজার ৮৭৫টি শিশু ভর্তি হয়েছিল। শিশু বিভাগের চারটি ওয়ার্ডের মধ্যে এ সময়ে ২৪নং ওয়ার্ডে ২০টি শিশু মারা গেছে। তাদের মধ্যে পাঁচটি শিশু ছিল নিউমোনিয়া আক্রান্ত। তিনি আরও জানান, হাসপাতালের শিশু বিভাগে বর্তমানে চিকিৎসক সংকট আছে। সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে নয়জন চিকিৎসক বদলি হয়েছেন। প্রশিক্ষণে আছেন ১১ জন। শিশু বিভাগে মেডিকেল অফিসারের আটটি পদ শূন্য। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের ছয় শিক্ষার্থী ওয়ার্ডে কাজ করছেন। তারাই মূলত পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। মূলত শিশু চিকিৎসক সংকটে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তবে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ জানান, শিশু রোগীর চাপ আছে ঠিক। তবে চিকিৎসা কার্যক্রম ঠিকঠাক মতো চলছে। চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে আমার জানা নেই।