Bangladesh

নিজস্ব আইনকানুন বা সংবিধানও কেন মানছে না ভারত

পাশাপাশি বেশকিছু রোহিঙ্গা মুসলিমকেও ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আন্দামান সাগরে নামিয়ে দিয়ে মিয়ানমারের দিকে সাঁতরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে— এমন ঘটনাও ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে ভারত যে অন্তত বেশ কয়েক হাজার সন্দেহভাজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে গোপনে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে বা ‘পুশইন’ করেছে— এই তথ্যর স্বীকৃতি মিলেছে দুই দেশেই নানা সূত্র থেকে।

পাশাপাশি বেশকিছু রোহিঙ্গা মুসলিমকেও ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আন্দামান সাগরে নামিয়ে দিয়ে মিয়ানমারের দিকে সাঁতরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে— এমন ঘটনাও ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

ভারত যে এই পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, রীতিনীতি ও সনদ লঙ্ঘন করে, বিশেষজ্ঞরা সবাই প্রায় তা নিয়ে একমত। এমনকি, ভারতের নিজস্ব আইনকানুন বা সংবিধানও এক্ষেত্রে মানার কোনো অভিপ্রায় দেখা যাচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকে।

মানবাধিকার ও শরণার্থী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা অনেকেই বলছেন সীমান্ত দিয়ে জোর করে অন্য দেশে ঠেলে দেয়ার এই ধরনের ঘটনা বা ‘পুশইন’ ভারত যে এই প্রথম শুরু করলো তা নয়। কিন্তু আগে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও এই প্রথম এটাকে একটা ব্যাপক জাতীয় স্তরের ‘স্ট্র্যাটেজি’ বা কৌশল হিসেবে অনুসরণ করা হচ্ছে।

এই কৌশলের অংশ হিসেবেই দিল্লি, রাজস্থান, জম্মু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা বা কর্ণাটকের মতো বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সন্দেহ হলেই ঢালাওভাবে আটক করে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের মতো রাজ্যে।

তারপর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফের হাতে এই লোকজনদের তুলে দেয়া হলে তারাই রাতের অন্ধকারে বা বন্দুকের মুখে এদের ঠেলে দিচ্ছে সীমান্তের অন্য পারে— এমন অজস্র বিবরণ পাওয়া গেছে গত কয়েক মাসে।

গত ৩ জুলাইও (বৃহস্পতিবার) ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ এয়ারক্র্যাফট এরকম ২৫০ জন নারী-পুরুষকে গুজরাটের ভাদোদরা থেকে এয়ারলিফট করে উত্তর-পূর্ব ভারতে এনে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে ভারতীয় মিডিয়া রিপোর্ট করেছে।

এদেরও পুশইন করা হয়েছে ইতোমধ্যেই, অথবা হবে যেকোনো দিন।

দিল্লিতে সাউথ এশিয়া হিউম্যান রাইটস ডকুমেন্টেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক রবি নায়ার বলেন, “অনেকটা যেন ভারত সরকার এই লোকগুলোকে সোজা ‘কিডন্যাপ’ করে বর্ডারে নিয়ে এসে নো-ম্যানস ল্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছে।”

অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে নিজস্ব রীতিনীতি বা ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর’ আছে, সেটাও দিল্লি যে এখানে মানার কোনো ধার ধারছে না তা একেবারেই পরিষ্কার।

আর সেটা করাও হচ্ছে বেশ খোলাখুলি— গোটা অপারেশন নিয়ে খুব একটা লুকোছাপাও যে আছে, তাও নয়!

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ আইন ভেঙেও ভারত কেন আর কিভাবে এই বিতর্কিত ‘পুশইন স্ট্র্যাটেজি’ লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে?

এর জবাব খুঁজতেই বিবিসি বাংলা এই প্রতিবেদনে কথা বলেছে আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক কূটনীতিকদের সাথে। বোঝার চেষ্টা করেছে এই ইস্যুতে ভারত সরকার ও ভারতের শাসকদলের অবস্থানও।

‘ভারত জানে পশ্চিমারাও এই ইস্যুতে কিছু বলবে না’

নন্দিতা হাকসার ভারতের সুপরিচিত লেখক ও প্রথম সারির মানবাধিকার আইনজীবী। ভারতে আশ্রয় নেয়া বিদেশী শরণার্থীদের অধিকার আন্দোলনে তিনি যুক্ত বহু বছর ধরে।

একাত্তরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন পি এন হাকসার, তার কন্যা নন্দিতা সে সময়ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য দিল্লির রাজপথে নিজে টাকা তুলেছেন।

বাংলাদেশ যে তার আলাদা একটা দুর্বলতা, সেটা তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে একাধিকবার এই প্রতিবেদককে বলেছেন। এবং এই মুহূর্তে যেভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অসহায় নারী-পুরুষদের পুশইন করা হচ্ছে, তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মানছি ভারত ১৯৫১-এর রিফিউজি কনভেনশন (শরণার্থী সনদ) বা ১৯৬৭ প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। কিন্তু তারপরও মানবাধিকার নিয়ে যত আন্তর্জাতিক আইন আছে ভারত তা মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে, এমনকি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের নির্বাহী কমিটিতেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব আছে।’

‘এরপরও যেভাবে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার থেকে আসা লোকজনদের সীমান্ত দিয়ে জোর করে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, সেটা স্পষ্টতই সেই আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার লঙ্ঘন।’

দ্বিতীয়ত, ভারতের সংবিধানের আর্টিকল ২১ যে ‘রাইট টু লাইফ’ (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার) দিয়েছে ও আর্টিকল ১৪ যে ‘ইক্যুয়ালিটি বিফোর ল’ (আইনের চোখে সবাই সমান) নিশ্চিত করেছে— সেই দুটো মৌলিক অধিকারও এখানে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে নন্দিতা হাকসার মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে শুধু নাগরিকদের নয়, ভারতের সংবিধান কিন্তু এই অধিকার ভারতের ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষকে দিয়েছে— তিনি বিদেশী হতে পারেন, শরণার্থী হতে পারেন, তাতে কিছু আসে যায় না।’

যার অর্থ— ভারতীয় ভূখণ্ডে একবার অবৈধভাবেও যদি কেউ প্রবেশ করে থাকেন, তারপরও তার কিছু কিছু অধিকার থাকে, যেগুলো এখানে প্রয়োগ করার সুযোগই তাকে দেয়া হচ্ছে না।

তবে এতরকম আইনি সুরক্ষার পরও ভারত যে সেগুলো সচেতনভাবেই অগ্রাহ্য করার নীতি নিয়েছে— তার পেছনে আসল কারণটা সম্পূর্ণ অন্য বলেই নন্দিতা হাকসারের অভিমত।

তার অভিমত, ‘এই মুহূর্তে আমেরিকা বা ইউরোপ যেভাবে তাদের দেশে আসা অভিবাসীদের তাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে এবং সেখানে কোনো আইনকানুনের ধার ধারছে না, তাতে তো ভারতকে তো তাদের কিছু বলার মুখই নেই!’

‘ডোনাল্ড ট্রাম্প প্লেনবোঝাই করে অভিবাসীদের ভারত, মেক্সিকো বা ল্যাটিন আমেরিকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ব্রিটেন ঘোষণা করেছে, ব্যর্থ অ্যাসাইলাম সিকারদের রুয়ান্ডায় পাঠাবে। ডেনমার্কও একই জিনিস উগান্ডাতে করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে,’ বলেন তিনি।

তার যুক্তি, পশ্চিমা বিশ্ব নিজেরাই যখন মানবাধিকার সনদের পরোয়া না করে ঢালাওভাবে অভিবাসীদের ডিপোর্ট করছে, তখন নরেন্দ্র মোদি সরকারও সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একই জিনিস বাংলাদেশ বা মিয়ানমারে করছে। কারণ তারা জানে এই ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে দিল্লিকে কোনো চাপের মুখে পড়তেই হবে না!

‘আটকদের ন্যূনতম যাচাই-বাছাইটাই তো হচ্ছে না’

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর, ভারত ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কাজ করছেন বহু বছর ধরে।

তিনি এ কথা মানেন যে একটা দেশের অবশ্যই অধিকার আছে তার দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের বের করে দেওয়ার। কিন্তু সেইসাথে তিনি মনে করিয়ে দেন যে তার একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতিনীতি আছে, নিয়মকানুন বা প্রোটোকল আছে!

‘যেমন ধরুন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও ভারতে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছেন। আমরা সেটা সমর্থন করি বা না করি। এটা তো দেখা যাচ্ছে ভারতের কাছে তথ্য পাঠিয়ে এই অভিবাসীদের পরিচয় আগে যাচাই করা হচ্ছে এবং ভারত রাজি হওয়ার পরই কেবল তাদের নিয়ে প্লেন দিল্লি বা অমৃতসরে এসে নামছে।’

‘এটা যতই অমানবিক হোক, একটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে বলে ভারতও প্রকাশ্যে অন্তত এর কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি এবং এই ডিপোর্টিদের ভারতীয় নাগরিক বলে মেনেও নিয়েছে।’

‘কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত কিন্তু সেই পদ্ধতিটা নিজেরা মানার কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মীনাক্ষী গাঙ্গুলি।

বস্তুত গত কয়েক মাসে ভারত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে যতজনকে আটক করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে, সেগুলোর কোনোটির ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের কাছে তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করতে পাঠানো হয়নি।

অথচ নিয়মমাফিক এই ধৃতদের নাম-পরিচয় এবং বাংলাদেশে কথিত ঠিকানা যাচাই করার জন্য সেটা আগে নিকটতম দূতাবাসে পাঠানোর কথা।

‘এই ভেরিফিকেশনের কোনো পার্ট নেই বলেই আমরা দেখেছি অনেক ভারতীয় নাগরিককেও ভুল করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। এবং পরে ভুল বুঝে তাদের ফেরতও আনতে হয়েছে,’ বলেন মীনাক্ষী গাঙ্গুলি।

আরো একটা বিষয়ের দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন— এপর্যন্ত যতজনকে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করা হয়েছে তাদের সবাই কিন্তু বাংলাভাষী মুসলিম।

‘এখন এই যে বেছে বেছে বাঙালি মুসলিমদের পাকড়াও করে তাদের সীমান্তের ওপারে চালান করা হচ্ছে, এটা ভারতের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার অংশ এমন সন্দেহ কিন্তু করা যেতেই পারে।’

‘আর সেটা সত্যি হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতেই পারে না,’ মন্তব্য করেন মীনাক্ষী গাঙ্গুলি।

সুতরাং গোটা অপারেশনটা নিয়ে ভারত এই যে একটা বেপরোয়া মনোভাব দেখাচ্ছে এবং কোনো রীতিনীতি মানার তোয়াক্কা করছে না, তার একটা বড় কারণ হতে পারে খুব সচেতনভাবে একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই স্ট্র্যাটেজি নেয়া হয়েছে এবং আপাতত অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করে যাওয়া হচ্ছে।

‘ঢাকাকে একটা বার্তা দিতেই এটা করা হচ্ছে’

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী আবার বিশ্বাস করেন, বর্ডার দিয়ে এই যে লোকজনকে ঠেলে ফেরত পাঠানো, সেটা আসলে বাংলাদেশের জন্য ভারতের একটা ‘মেসেজিং’ – মানে বার্তা দেয়া।

ঢাকায় ভারতের এই সাবেক হাইকমিশনার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই জিনিস তো নতুন কিছু নয়! আগেও যখনই দেখা গেছে ঢাকাতে আমাদের প্রতি তত বন্ধুত্বপূর্ণ নয় এমন সরকার (‘আনফ্রেন্ডলি রেজিম’) ক্ষমতায় এসেছে, তখনই আমরা এ জিনিস করেছি।’

‘উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার— বাংলাদেশকে একটা বার্তা দেয়া যে তোমরা যদি বেশি ঝামেলা করো তাহলে ভারতে তোমাদের যত ইল্লিগ্যাল লোকজন আছে তাদের এক-ধারসে ফেরত পাঠানো হবে।’

‘আবার খেয়াল করে দেখবেন, যখনই ঢাকার সাথে দিল্লির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তখনই এগুলোতে ভাটা পড়েছে, কিংবা বলা যায় ভারত এই অনুপ্রবেশের বিষয়টা ইচ্ছে করে তখন ওভারলুক করেছে,’ বলেন তিনি।

অতএব ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কে ইদানীং যে ধরনের শীতলতার আভাস দেখা যাচ্ছে – এবং দুই দেশ পরস্পরের নানা ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা বাতিল করে দিচ্ছে – এই পুশইনও তারই ধারাবাহিকতা, এমনটাই মনে করেন পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী।

ভারতের বিজেপি সরকার একটা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে এই অভিযান শুরু করেছে এই অভিযোগও তিনি মানেন না, কারণ নইলে ‘কর্ণাটকের মতো কংগ্রেসশাসিত একটা রাজ্য থেকেও লোকজনকে বর্ডারে ফেরত পাঠানো হতো না!’

এই অভিযানে বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাগরিককেও যে ভুল করে সীমান্তের অন্য পারে পাঠানো হয়েছিল, সেটাকেও তত গুরুত্ব দিতে নারাজ তিনি।

তিনি বলেন, ‘শত শত লোকের মধ্যে এমন দু’চারটে ভুল হতেই পারে।’

‘কিন্তু আপনি দেখুন, বেশির ভাগ লোক বাংলাদেশে গিয়ে কী বলছেন? না আমরা এই দেশেরই অমুক জেলার অমুক গ্রামের লোক— ইন্ডিয়া আমাদের জোর করে ফেরত পাঠিয়েছে।’

‘তো তারা নিজেরাই যখন মেনে নিচ্ছেন তারা বাংলাদেশী, তো ভারতের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলার তো কোনো মানেই হয় না!’

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মন্তব্য করেছেন, ভারতের এই পুশইন ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশের আসলে তেমন কিছু করার নেই।

তার সেই বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘উনি বাস্তববাদী লোক, বাস্তবতাটা বোঝেন। ভারতের এই পদক্ষেপ যে অন্যায় বা বেআইনি কিছু নয়, আমি তো বলব সেটাই প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন তিনি।’

এই কারণেই ভারতের এটা নিয়ে অপরাধবোধে ভোগারও কোনো কারণ নেই— যুক্তি দেখান পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী।

‘এন্ট্রি যখন অবৈধ, এক্সিট কিভাবে বৈধ হবে?’

ভারতের নানা প্রান্তে কথিত বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের বিজেপি নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এই ক্র্যাকডাউন অপরিহার্য ছিল।

বস্তুত পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের ওপর সশস্ত্র বন্দুকধারীদের হামলা এবং তারপর ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে সামরিক অভিযান, সে সময় থেকেই এসব ধরপাকড় আর পুশইনের তীব্রতা অনেক বেড়েছে।

ভারতে বিজেপির ঘনিষ্ঠ তাত্ত্বিক ও দক্ষিণপন্থী চিন্তাবিদ শুভ্রকমল দত্তর মতে, নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর স্বার্থে ভারত যদি এই লোকজনকে জোর করেও নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠায়, তাহলেও দিল্লিকে দোষ দেয়া যায় না।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেখুন, যদি ডিপোর্টেশন সব নিয়ম মেনেটেনে করা যেত, আরো ভালো হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্নটা যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার, তখন সেই দাবিটাই সবার আগে।’

‘তাছাড়া যে মানুষগুলো বেআইনি পথে ভারতে ঢুকেছেন, কিংবা ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও থেকে গেছেন অথবা ভারতে এসে অবৈধ রাস্তায় এদেশের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ইত্যাদি জোগাড় করেছেন, তাদের সাথে পাল্টা নিয়ম মানার কি দায় ভারত সরকারের আছে?’

‘সোজা কথায়, এদেশে যাদের এন্ট্রিটাই অবৈধ, তাদের এক্সিটটা শতকরা এক শ’ ভাগ বৈধ না হলেও মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে না,’ বলেন শুভ্রকমল দত্ত।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশে ডিপোর্টেশন হচ্ছে— এ কথা একরকম মেনে নিলেও সীমান্ত দিয়ে জোর করে ঠেলে দেয়ার ঘটনা বা ‘পুশইন’ যে ঘটছে, সেটা কিন্তু ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকার করেনি।

শুধু আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা গত ১০ মে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, তার রাজ্য থেকে সম্প্রতি মোট ৩০৩ জন অবৈধ বিদেশীকে ‘ইমিগ্রান্টস (এক্সপালশন ফ্রম আসাম) অ্যাক্ট ১৯৫০’র আওতায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

কিন্তু সেটা বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিক্রমে, নাকি জোর করে গোপনে বা রাতের অন্ধকারে বর্ডার পার করে দিয়ে — তা তিনি স্পষ্ট করেননি।

গত কয়েক মাসের ভেতর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকেও একাধিকবার এবিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

নিয়মিত ব্রিফিংগুলোতে তিনি সেই প্রশ্নের জবাবে বারবার একই গৎবাঁধা উত্তর দিয়ে গেছেন, ‘দেখুন, আমাদের দেশে নিয়ম ও আইন মোতাবেক বহু বিদেশী আসা-যাওয়া করেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই।’

‘কিন্তু নিয়ম আর আইন ভেঙে কেউ যদি ভারতে আসেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা তো নিতেই হবে। ফলে এই প্রশ্নের জবাব খুব সহজ— আমাদের সেনা বা সীমান্তরক্ষীরা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং তারা নিজেদের কর্তব্য করে যাবেন!’

কিন্তু সীমান্তে ‘ফোর্সড ডিপোর্টেশন’র ঘটনা ঘটছে কি না, বা ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে বিদেশীদের জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছে কি না— সে প্রশ্নের জবাব তিনি সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন।

মানে কোন পন্থা বা পদ্ধতিতে ভারতের সেনা ও সীমান্তরক্ষীরা এখানে তাদের ‘কর্তব্য’ পালন করে যাচ্ছেন, সরকার তা নিয়ে নীরব থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto